অসম্ভব গরম পড়েছে। বেগুনি রঙের জারুল ফুল ফুটে আছে। টিনের চালের স্কুল আর দ্বিতীয় কলাভবনের মাঝখানে সারি বেঁধে জারুল গাছের সারি। ফুলগুলোর পাপড়ি নরম টিস্যু পেপারের মত। প্রচন্ড গরমে বছরে একবারই ফোটে জারুল ফুল। কলিটা ফেটে হঠাৎ ক'রে যেন পুটুস ক'রে ফুটে ওঠে ফুল।
যখন গরম আর সহ্য করা যাচ্ছে না ঠিক তখন বৃষ্টি নামল। টিনের চালে ঝম ঝম শব্দ। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ ভুলে যাওয়া স্বপ্নের মত মনে হয়। অন্ধকার হ'যে গেছে ক্লাসরুম। আল মাহমুদ স্যার ফিজিক্স পড়াচ্ছেন। ল্যাবরেটরিতে ব্যাঙ কাটা শেখাচ্ছেন অনু স্যার। ভদ্র স্যার হয়ত অংক করাচ্ছেন। হেডস্যার বলছেন বাংলা রচনায় সব সময় কোটেশন দেওয়া চাই।
এই আমাদের স্কুল। রাজশাহী ইউনিভার্সিটি এক্সপেরিমেন্টাল স্কুল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষামূলক শিক্ষায়তন। হ্যাঁ সত্যি, ইউনিভার্র্সিটির ভিতর এক এক্সপেরিমেন্ট হিসাবেই শুরু হয়েছিল এই স্কুল ইউনিভার্র্সিটির টিচারদের ছেলে মেয়েদের জন্য।
শহরের অন্যান্য বিখ্যাত সরকারি স্কুল থেকে একটু আলাদা স্কুলটা। আলাদা পি.এন স্কুল, হেলেনাবাদ স্কুল , কলেজিয়েট স্কুল, শিরোল স্কুল থেকে। ম্যাট্রিক পরীক্ষায় কোন সাজেশন পাওয়া যায় না আমাদের স্কুলে। কোন চ্যাপ্টার ইমপরট্যান্ট তা কোন স্যার বা আপা বলে দেন না। বই এর এ মাথা থেকে শেষ পর্যন্ত পড়তে হয়। মাঝে মাঝে ইউনিভার্র্সিটির টিচার রা এসে ক্লাস নেন। ইউনিভার্র্সিটির অসম্ভব প্রতিভাবান তরুণ শিক্ষক তরফদার চাচা এসে কেমিস্ট্রি পড়িয়ে যান। আমরা শিখি কেমিস্ট্রি শুধু মুখস্ত করবার জিনিস নয়।
কিছুদিন আগে আমাদের স্কুলের পঞ্চাশ বছর পূর্তি অনুষ্ঠান হ'ল। তার পত্রিকায় বন্ধুপ্রতিম নাজ(নাজনীন সুলতানা) একটা অসাধারণ লেখা লিখেছে। তার কিছুটা তুলে না দিয়ে পারছি না।
“টিন শেড স্কুলের গাড়ি বারান্দা, আর প্রথম সারি ও দ্বিতীয় সারি রুমগুলোর মাঝে ছিল সামান্য ফাঁকা জায়গা। ক্লাশ শুরুর আগে বা টিফিনের সময় বন্ধুরা মিলে সেখানে নিয়মিত ' কুমির তোর জলে নেমেছি' খেলতাম।
আমরা যারা পূর্বপাড়া থেকে যেতাম তারা টিফিনের সময় ক্লাশ রুমে সবার টিফিন বক্স এক সাথে খুলে সবাই মিলেমিশে খেতাম। হাতে বানানো আটার রুটি, সাথে আলু ভাজা বা ডিম ভাজা, শুকনো মিষ্টি, ফল -এসবই ছিল আমাদের নিত্যদিনের খাবার। স্কুলের পাশে বিক্রি হত লোভনীয় তেঁতুলের আঁচার, বরফ। শুধু পানির বরফের দাম ছিল ১০ পয়সা, আর সামান্য দুধ দেওয়া, আগায় নারিকেলের কুঁচি বসানো আইসক্রিমের দাম ছিল ২৫ পয়সা। কখনও কখনো কাঁচা আম ক্লাশের দরজার ফাঁকে চাপ দিয়ে থ্যাতলানো অবস্থায় লবন ছিটিয়ে খেতাম।”
আমাদের 'কুমির তোর জলে নেমেছি' খেলায় কুমির জলে থাকত মানে থাকত বারান্দার নিচে মাঠে। আর আমরা সব বারান্দায়। তারপর কুমিরের এপাশ, ওপাশ দিয়ে কুমিরকে লোভ দেখিয়ে জলে নামতাম। আর ছড়া কাটতাম, ‘কুমির তোর জলে নেমেছি, কুমির তোর জলে নেমেছি।’ কুমির ছুঁয়ে দিলেই যাকে ছোঁবে সে তখন নতুন কুমির।
ছেলেবেলায় এমন কত যে খেলা খেলতাম আমরা। আমার ছোটমাসীর মেয়ে প্রভার সাথে গল্প করছিলাম সেদিন এই খেলাগুলো নিয়ে। ও আমার থেকে অনেক ছোট। কিন্তু ওরাও হলিক্রস স্কুলে খেলত এসব খেলা। এতদিন পর খেলাগুলো ঠিকমত মনে নেই আমার। প্রভার কাছে শুনে আবার ফিরে এল ছেলেবেলা। যদিও বেশীর ভাগ খেলাতে সবাই আমাকে ‘মিল্ক রাইস’ করত। ‘দুধ ভাত।’ আমি কাউকে ছুঁয়ে দিলেও কিছু যায় আসে না, কেউ আমাকে ছুঁয়ে দিলেও কোন লাভ ক্ষতি নেই । চিরকালীন এলেবেলে । আসলে স্কুলের পড়াশোনাটা আমি করতে পারতাম, খেলাধূলা একেবারেই না। কিন্তু খুব ইচ্ছা ছিল কেউ আমায় দলে নিক, আমাকেও কেউ খেলোয়াড়ের সম্মান দিক । জীবনে সব ইচ্ছা কি পূরণ হয়? ‘মিল্ক রাইস’ আর ‘দুধ ভাত’ হয়েই কেটে গেছে আমার স্কুল জীবন।
মনে পড়ছে "এল ও এন ডি ও এন লন্ডন" খেলাটার কথা । লীডার উল্টোদিকে মুখ ক'রে দাঁড়িয়ে থাকত। আমরা আড়াআড়ি লাইন ক'রে পিছনে। লীডার বলত টানা সুরে, "এল ও এন ডি ও এন লন্ডন"। সে কথার ফাঁকে আমরা এক পা এক পা ক’রে এগিয়ে যেতাম । তারপর লীডার ঘুরে দাঁড়ানোর আগে নড়াচড়া না ক’রে শান্ত হ’য়ে, স্থির হ’য়ে দাঁড়িয়ে পড়তে হ'ত। লীডার ঘুরে যদি কাউকে নড়তে চড়তে দেখত সে আউট। আর যে এক পা এক পা ক’রে এগিয়ে লীডারকে ছুঁতে পারবে তখন সেই হ’ত নতুন লীডার ।
খেলতাম ‘টি টি টি তোমার কি রং চাই?’ ‘টি টি’-র বাংলা ক’রে ‘চাচা তোমার কি রঙ চাই?’ একজন চোর হ’ত। এ খেলায় দলে অনেক লোক থাকত । আমরা সবাই চোরকে ঘুরে ঘুরে সুর ক’রে বলতাম ‘টি টি টি তোমার কি রং চাই?’ ‘চাচা তোমার কি রঙ চাই?’ হাত পা নেড়ে ভেংচি কেটে নানা রকম নাচানাচি করতাম । তারপর চোর কোন একটা রঙ বললেই সেই রঙ খুঁজতে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিতাম আমরা। রং খুঁজে পাওয়ার আগে যদি কাউকে ছুঁয়ে দিত চোর তবে সে তখন হ’ত নতুন চোর।
স্কুলে নানা রঙ খুঁজে পেতে একটু মুশ্কিল হ’ত যদিও। আমরা স্কুল ড্রেস পড়ে থাকতাম, নানা রঙের পোশাকের সুযোগ নেই। ছোট ক্লাশে মেয়েদের নেভী ব্লু স্কার্ট, সাদা শার্ট। গলায় সাদা স্কার্ফ। ছোট ছেলেদের নেভী ব্লু হাফ প্যান্ট, সাদা শার্ট । বড় ছেলেদের নেভী ব্লু ফুল প্যান্ট, সাদা শার্ট । সাদা কেডস সকলের। সাদা চক দিয়ে ঘষে ঘষে সাদা রং করতাম তা। কালো চামড়ার জুতাও ছিল। কিন্তু পি টি ক্লাশের দিন কেডস পড়ে আসতে হ’ত। বড় ক্লাশের মেয়েদের নেভী ব্লু টিউনিক; সাদা শার্ট; সাদা সালোয়ার; সাদা স্কার্ফ ; সাদা বেল্ট; কড়কড়ে মাড় দেওয়া, ফোল্ড করে ইস্ত্রি ক’রা সাদা ওড়না । অবশ্য আমাদের টিফিন বক্স আর স্কুলের ব্যাগে রঙের অভাব ছিল না । স্কুলের স্যার আপাদেরও তো আর স্কুল ড্রেস ছিল না। কিন্তু ‘টি টি টি তোমার কি রং চাই’ বলে ওঁনাদের ছোঁবার সাহস আমাদের কোনদিন হ’ত না।
আমাদের গলার সাদা স্কার্ফ খুব কাজে আসত রুমাল চুরি খেলা আর কানা মাছি ভোঁ ভোঁ খেলা খেলবার সময়ও।
রুমাল চুরি খেলায় সবাই গোল হ’য়ে চোখ বন্ধ ক’রে বসতাম । একজন চোর হ’ত। কোন একটা জনপ্রিয় গান করতে থাকতাম । গান চলবার সময়ে চোর রুমাল অর্থাৎ গলার স্কার্ফটা বসে থাকা কারো পিছনে খুব সন্তর্পণে রেখে দিত। যদি সে সাথে সাথে বুঝতে পারত তার পিছনে রুমাল রাখা হয়েছে, তবে উঠে চোরকে ধরতে পারলে সে তখন নতুন চোর হ’ত আর চোর তার জায়গায় বসে পড়ত । তা না হ’লে গান শেষ হ’লে, ঘুরে ঘুরে চোর এসে যার পিছনে রুমাল আছে তার পিঠে টোকা দিত। সে তখন উঠে চোরের পিছনে দৌঁড় দৌঁড়। চোরকে ছুঁতে হবে। আর চোরও দৌঁড়াচ্ছে তার খালি জায়গা টা নেওয়ার জন্য। চোরকে ছুঁতে না পারলে সেই তখন হ’বে নতুন চোর।
গলার স্কার্ফ কাজে আসত ‘কানামাছি’ খেলাতেও । সবাই গোল হ’য়ে দাঁড়াতাম। মাঝখানে একজন চোখে স্কার্ফ বেঁধে। সেই হচ্ছে ‘কানামাছি’ । আমরা আমাদের গোলটার পরিধি আস্তে আস্তে বড় করতে থাকতাম । ‘কানামাছি’ আমাদের ছোঁওয়ার চেষ্টা করত । আর আমরা সুর ক’রে ক’রে ছড়া বলতাম, ‘কানামাছি ভোঁ ভোঁ যাকে পাবি তাকে ছোঁ।’ আর কানামাছির গায়ে টোকা দিতাম । যদি ‘কানামাছি’ চোখ বাঁধা অবস্থায় কাউকে ছুঁয়ে তার ঠিক ঠিক নাম বলতে পারত তবে সে হ’ত নতুন কানামাছি।
আমাদের খুব প্রিয় খেলা ছিল ওপেনটি বায়োস্কোপ। দুই দলের রাজা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দু’ হাত উঁচু ক’রে ধনুকের মত করত। তার ভিতর দিয়ে আমরা সবাই কাঁধে হাত দিয়ে লম্বা লাইন ক’রে ঘুরে ঘুরে যেতাম । সেই সাথে সুর তুলে গান করতাম
“ওপেনটি বায়োস্কোপ
নাইন টেন টেইস্কোপ
সুলতানা বিবিয়ানা
সাহেব বাবুর বৈঠক খানা
সাহেব বলেছে যেতে
পান সুপারি খেতে
পানের আগায় মরিচ বাটা
ইস-স্প্রিঙের চাবি আঁটা
যার নাম রেনু বালা গলায় দিলাম মুক্তার মালা।”
গলায় দিলাম মুক্তার মালা ব’লে যে সে মুহুর্তে ধনুকের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল তাকে ধরে ফেলা হ’ত। রাজারা তাকে জিজ্ঞাসা করত সে কোন দলে যাবে। এইভাবে সবাই একে একে ধনুকে ধরা পড়ে নিজেদের দল ঠিক ক’রে নিত। তারপর আসল মজা। দুইদলে দড়ি টানাটানির মত টানাটানি খেলা হ’ত। দড়ি ছাড়াই। কোন দল জিতল?
এখনো মাঝে মাঝে স্বপ্নের ভিতর ফুল টোক্কা খেলাটার কথা মনে পড়ে। কে যেন বলছে, ‘আয় রে আমার টগর’ ‘আয়রে আমার বেলী’। সন্ধ্যা হ’য়ে আসছে। আজান এই বুঝি দিল। তবু ‘আয় রে আমার টগর’।
ফুল টোক্কা খেলাটা দাবা খেলায় বোড়ের এগিয়ে যাওয়ার মত। দু’ দলে খেলা হ’বে। দু’ দলে দু’টো রাজা থাকবে । প্রত্যেক রাজা তার দলের সকলের এক একটা ক’রে ফুলের নাম দেবে। দল দু’টো মুখোমুখি লম্বা লাইনে বসবে । এক দলের রাজা অন্য দলের কাছে গিয়ে একজনের চোখ দু’হাত দিয়ে ঢেকে নিজ দল থেকে ডাকবে, ‘আয় রে আমার টগর’ কিংবা ‘আয়রে আমার বেলী’। তখন টগর বা বেলী এসে কপালে টোকা দিয়ে যাবে। রাজা যখন চোখ খুলে দেবে, তখন বলতে হবে কাকে ডেকেছিল । ঠিক বলতে পারলে এক লাফে যতদূর এগোতে পারে ততদূর যাবে । ঠিক বলতে না পারলে যে টোকা দিতে এসেছিল সে লাফ দিয়ে অন্য দলের দিকে যতদূর যেতে পারে যাবে। এভাবে যে দল আগে অন্যদলকে পার করে যেতে পারবে সেই দল জিতবে ।
ইঁদুর, বিড়াল খেলায় একজন ইঁদুর হ’বে, একজন বিড়াল হ’বে। বাকি সবাই হাতে হাত ধরে ধরে গোল হ’য়ে দাঁড়াবে। সবাই ইঁদুরের পক্ষে। ইঁদুর ভিতরে থাকবে, বিড়াল বাইরে। বিড়াল হাতের ভিতর দিয়ে হোক যেভাবে হোক ভিতরে ঢুকে ইঁদুর ধরবার চেষ্টা করবে। সবাই বাঁধা দেবে। ইঁদুর ধরা যাবে না । ইঁদুরকে বাঁচানো চাই।
আরো কত খেলা। ইচিং বিচিং চিচিং চা, প্রজাপতি উড়ে যা। দু’জন মাটিতে পা ছড়িয়ে বসত। পায়ের পাতায় পায়ের পাতা লাগিয়ে। অন্য দু’জন ইচিং বিচিং চিচিং চা, প্রজাপতি উড়ে যা বলে ঘুরে ঘুরে লাফ দিত সে দুই পা’র ফাঁকে।
দড়ি টানাটানি খেলা আমরা এমনি খেলতাম না। কিন্তু সবসময় দড়ি টানাটানি খেলা থাকত স্কুলের স্পোর্টস ডে তে। আহা স্পোর্টস ডে! লাল নীল কাগজে তিন কোণা ফ্ল্যাগ বানিয়ে ময়দা দিয়ে আঠা ক’রে সেই ফ্ল্যাগ চিটানো হ’ত দড়িতে। তারপর সেই ফ্ল্যাগওয়ালা দড়ির মালা চারদিকে ঝোলানো হ’ত। দড়ি টানাটানিতে ক্লাশ নাইনের উল্টোদিকে ক্লাশ টেন বা স্যারদের বিপরীতে আপারা। দড়ির মাঝখানে একটা রুমাল বাঁধা থাকত। তার দু’পাশে দু’দল। যে দল টেনে অন্য দলের সবাইকে নিজেদের দিকে নিয়ে আসতে পারবে সে দলের জিত। আপারা জিততে পারল না স্যাররা জিততে পারল তা নিয়ে ভীষণ হুল্লোড় পড়ে যেত আমাদের মধ্যে।
যখন এসব দেশজ খেলা খেলতাম না, আমরা খেলতাম স্কুলের মাঠে ব্যাডমিন্টন। যদিও আমি ব্যাডমিন্টন পর্যন্ত খেলতে পারতাম না। মনে মনে যদিও সবসময় ভাবতাম খেলাতেও আমি ট্রফি পাব । আসলে স্কুলে মনে হ’য় শুধু দাবা খেলায় আমি পুরস্কার পেয়েছিলাম। তাও দাবার পুরস্কার স্পোর্টস ডে তে মনে হ’য় দেয় নি । কালচারাল অনুষ্ঠানের বিতর্ক প্রতিযোগিতা , আবৃতি এইসবের সাথে দিয়েছিল। অথচ স্পোর্টসের মাঠে সকলের সামনে দিয়ে গর্বভরে হেঁটে গিয়ে পুরস্কার নেওয়ার কত যে লোভ ছিল আমার! আর সেই ভিক্টরি স্ট্যান্ড! আহা!
সময়ের অভাবে যে সব খেলা আমরা স্কুলে খেলতে পারতাম না তা খেলতাম বাড়ি গিয়ে। বাড়ির সামনের মাঠে খেলতাম দাঁড়িয়া বাঁধা, নুনা বদন, বৌচি, টিপু, মোরগ লড়াই, গোল্লাছুট, টিলো এক্সপ্রেস, হা ডু ডু। সিঁড়িঘরে লুকোচুরি।লিসাদের বাড়ির সামনের পার্কে গাছ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঝাঁই ঝাপ্পা কানাই মাছি। বারান্দায় খেলতাম কিত্ কিত্, এক্কা দোক্কা । ছেলেরা খেলত গুলি, লাট্টূ, উড়াত ঘুড়ি। বন্ধুদের সাথে ধাক্কাধাক্কি ক’রে খেলে হাঁটুর আর কনুই-এর চলটা উঠিয়ে ফেলেছিলাম আমরা। আমাদের ভিডিও গেম ছিল না ।
এখনো খুব মনে পড়ে টিপু খেলার কথা। দুই দল হ’ত। দল দু’টো নিজেদের মধ্যে কয়েক গজ দূরে দাঁড়াত । মাঝখানে পিরামিডের মত ক’রে সাতটা, নয়টা বা এগারোটা পাথর সাজিয়ে রাখা হ’ত। প্রথম দলের থেকে একজন একটা বল দিয়ে পিরামিডের দিকে ছুঁড়ে মারত। যদি পিরামিডটি ভাংতে পারে। তিনবার সুযোগ দেওয়া হ’ত । যদি সে পিরামিড ভাংতে না পারে তখন দ্বিতীয় দল চেষ্টা করত । আর যদি প্রথমদলের জন পিরামিড ভাংতে পারল কিন্তু দ্বিতীয় দলের কেউ বল মাটি ছোঁওয়ার আগে তা ধরে ফেলল, তবে দ্বিতীয় দলের টার্ন এসে যেত। তারা তখন পিরামিডে বল ছুঁড়বে। আর যদি দ্বিতীয় দলের কেউ বল্ টা ধরতে না পারে, তবে তাদের কাজ হবে প্রথম দল যেন আবার পিরামিড বানাতে না পারে তা দেখা। দ্বিতীয় দল বল ছুঁড়ে ছুঁড়ে প্রথম দলের কাউকে ছুঁতে পারলে তারা হেরে যাবে। আর যদি প্রথম দলের কাউকে বল ছুঁতে না পারে আর তারা পিরামিড সাজাতে পারে তবে তাদের আবার টার্ন হ’বে পিরামিডে বল ছোঁড়ার। আর তা না হ’লে দ্বিতীয় দলের টার্ন এসে যাবে। পিরামিড সাজিয়ে আমরা তারস্বরে সুর ক’রে বলে উঠতাম ‘টিপু’।
আর সেই যে মোরগ লড়াই? ডান হাত পিছনে নিয়ে গিয়ে বাম পায়ের গোঁড়ালি ধরতে হ’বে । তারপর পিঠের পিছন দিক দিয়ে বাম হাত নিয়ে গিয়ে ডান হাত ধরতে হ’বে। তারপর অন্য দের পাশে ঘুরে ঘুরে একজন আর একজনকে ধাক্কা দিতে হবে। ধাক্কা খেয়ে যার হাত বা পা আর মোরগের ভঙ্গীতে থাকবে না, সে আউট। শেষ পর্যন্ত যে মোরগের মত থাকতে পারবে সেই জিতবে।
কাচের মার্বেল দিয়ে গুলি খেলা হ’ত। ছেলেরাই বেশি খেলত। আর আমি অবাক হ’য়ে মার্বেলগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতাম । মসৃণ কাচের মার্বেল। নীল, সবুজ, সাদা বা লাল রঙের । ভিতরে সাদা, হলুদ , নীল বাবল মত । আমি খালি ভাবতাম কিভাবে ওই সাদা, হলুদ নীল রং মার্বেলের ভিতরে গেল ।
মাটিতে পায়ের গোড়ালি দিয়ে একটা ছোট গর্ত করা হ’ত। নীচু হ’য়ে বসে আঙ্গুল ধনুকের মত ক’রে মার্বেল ছুঁড়ে দিতে হ’ত গর্তে। নিজের গুলি দিয়ে গর্ত থেকে অন্যদের গুলি সরাতে হ’ত । আর যে প্রথম নিজের সব গুলি ওই গর্তের ভিতর ছুঁড়তে পারত সে জিতে যেত আর সব গুলি পেত।
ছেলেরা ছাদে উঠে লাল, নীল ঘুড়ি দিয়ে আকাশটা ছেয়ে ফেলত। আমার বড় লোভ হ’ত। কিন্তু মেয়েরা ঘুড়ি উড়ায় না। আমি পাশে দাঁড়িয়ে দেখতাম ওরা কাচের গুঁড়ো ক’রে তা দিয়ে মাঞ্জা বানাচ্ছে। সূতায় লাগিয়ে তা দিয়ে অন্যের ঘুড়ি কাটাকাটি করছে। দিদা সবসময় বলত ছাদের কার্নিশের কাছে যাবি না। আকাশে চোখ রেখে কার্নিশ টপকে মাটিতে পড়ে যাবি। বয়স্কদের কথা না শুনে কতবারই আমরা জীবনের কার্নিশ টপকে পড়েছি, আকাশে উড়ে গেছে নানা রঙের ঘুড়ি।
 |
ফটোগ্রাফার : শাহনাজ পারভীন |
Comments
Post a Comment