দমবন্ধ (৪)

সরোসরোসরো। গ্যারেজের দরজা খুলে ঘরের ভিতর দুটো চার ফুট বাই চার ফুট কাঠের তক্তা ঢুকছে। গেল গেলধর ধর। লাল আর তাথৈ কাঠের ভারে প্রায় মাটিতে নুয়ে পড়েছে। আবার দেখি কাঠের তক্তার উপর লাল রঙের বো লাগানো। কি ব্যাপারএ হচ্ছে আমার জন্মদিনের উপহার।

আহা জন্মদিন! ভাবলে নিজে থেকেই মুখটা হাসি হাসি হয়ে যায়। ছেলেবেলায় কত জন্মদিনই যে করেছে মা। আমাদের বাড়িতে তখন ওভেন ছিল না। তাতে কিকেরোসিনের স্টোভের উপর তাওয়া দিয়ে তার উপর বালি। লাল সাদা ডানো দুধের হাফ টিনের ভিতর ময়দাডিমচিনিবেকিং পাউডার দিয়ে বসিয়ে দাও। কিছুক্ষণ পর, ‘হয়েছেহয়েছে!’ যেন না হওয়ারই কথা ছিল। তবু অষ্টম আশ্চর্য – কেক হয়েছে। অবশ্য আমাদের এই ডানো টিনের কেকের পাশে প্রিয় বন্ধু ইয়াসমিনদের ধবধবে সাদা আইসিং দেওয়া আর তার উপর লালনীলসবুজরুপালি টিকটিকির ডিম বসানো কেকদের বড়ই রাজকীয় লাগত। ইয়াসমিনের মা জোনমাসি ব্রিটিশ মহিলা। ওঁনার বানানো কেক স্বর্গীয় তো হবেই।

কেকের সাথে জন্মদিনের প্লেটে থাকত নুডলস্। মা যখন ছোট ছোট চিংড়ি দিত নুডলস্-এআহা কী ভালোই যে লাগত। পায়েশ হত। আমার জন্মদিন গরমকালে বলে থাকত রসে টইটম্বুর টুকটুকে লাল তরমুজ। একবার মনে হয় তরমুজের জুস করেও অনেক সুনাম কিনেছিল মা। মাঝে মাঝে দিদা বানাত পাটিশাপটানাড়ু বা ছাঁচে গড়া ছানার সন্দেশ। ফুলমাছশঙ্খের মত শেপ। আমার কালোজাম পছন্দ হলেও দাদুভাই-এর কড়া শাসনে দেওয়া হত স্বাস্থ্যকর রসগোল্লা আর শবরি কলা। আমার ঝোলাঝুলিতে কখনো সাগরকলা ওরফে সিঙ্গাপুরী কলাও পাতে পড়েছিল। কিন্তু অত বড়া কলা খাওয়া ঠিক হবে না। ফলে দেওয়া হল অর্ধেক করে। সিঙ্গারা দেওয়া হত না কখনো। দেওয়া হত না লোভনীয় চটপটি। শুধু আমাদের স্বাস্থ্যই তো নয়আমার সব বন্ধুদের স্বাস্থ্যরক্ষার দায়িত্বও যেন দাদুভাই আর দিদার। এখনো মনে পড়ে সব সময় ভালো খাবার যোগাড়ে ব্যতিব্যস্ত দাদুভাই ফিরছে বাজার থেকে হাতে বড় রুইমাছ ঝুলিয়ে। কি মেসোমশাইকত দিয়ে কিনলেনএত তাজা মাছ!’ দাদুভাই বাজার নিয়ে ফেরা মাত্র আমরা বাড়ির সব সদস্য রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে। মাছের প্রশংসা করতে হবে। দাদুভাই দেখাচ্ছে। কানকো তুলে কী লাল। বুক টা মাছের প্রায় গোলাপি। দাদুভাই আজ নেই। রবিবারের বাজার থেকে আসা মাছ প্রশংসা করবার স্মৃতিটুকু থেকে গেছে। সেই সাথে জন্মদিনের স্বাস্থ্যকর রসগোল্লা।

মা সবসময় আমাদের জন্মদিনে বন্ধু বান্ধব আর তাদের বাবা মা মিলিয়ে নিমন্ত্রণ করে ফেলত প্রায় তিরিশ চল্লিশজন। আমরাও বন্ধুদের জন্মদিনে যেতাম গরমকালে নাকে পাউডার আর শীতকালে পন্ডস্‌ স্নো মেখে । গুডিব্যাগের চল ছিল না। নিজেদের জন্মদিনে উপহার হিসাবে পেতাম ব্রাউন কাগজ বা খবরের কাগজে মুড়ে বই। শকট থেকে রকেট বুদ্ধিমতী মাশা” দিয়েছিলাম শ্যামাকে। বই-এর উপযুক্ত মানুষ-কেই। ভিতরে লিখেছিলাম
'শুভ জন্মদিনে
শুভ কামনায় 
দিদিভাই
একুশে ফেব্রুয়ারি১৯৭৮'
একটু ফ্যান্সি পাতলা গোলাপি মত কাগজে মোড়া আর একটা উপহার। এই রকম সবুজহলুদগোলাপিলাল কাগজ দিয়ে স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় শিকল বানানো হত। এ কাগজে মুড়ে বেশি উপহার আসত না। মাঝে মাঝে শুধু। বই-এর নাম মোরগ ভাইটি।‘ ভিতরে গোটা গোটা মুক্তার অক্ষরে লেখা আছে
ছোট্ট মণিটির জন্মদিনে
জীবনের সার্থকতা কামনা করে-
দিপান ভাইয়া
মাঝে মাঝে পেন্সিল বক্স-ও পেতাম। নরম নরম স্পঞ্জমত তার ঢাকনি। গোলাপিসাদানীল রঙে ছবি আঁকা।

জন্মদিনে নতুন জামা হ'ত। তবে শুধু নিজেদের বাসা থেকে জামা পেয়েই সন্তুষ্ট থাকত না বুদ্ধিমতী মাশা আমার ছোটবোন শ্যামা। দুতিন বছর বয়স ওর। আমাদের ফ্ল্যাটের উপরতলায় থাকত রীণা আপাবেবী আপামিতু। ছোটমেয়েদের মনে হয় লোভ থাকে। বাবার লোভ।নিজের বাবা নেই বলেই কিনা জানি না শ্যামা বেবীআপাদের বাবাকে আব্বা ডাকত। জন্মদিনের আগে চুপিচুপি গিয়ে ও তার আব্বাকে বলে এল, ‘আমাকে আর দিদিভাই-কে জন্মদিনে জামা দিবেন।’ মেরুন রঙ্গের সুইস ভয়েলের কাপড় এল। দিদা জামা বানিয়ে দিল। আমাদের সব জামা ঘরে বানানো হত। দিদা বা মনিমার শিল্পকর্ম সেসব। কী তুলতুলে যে ছিল ওই জামা। বদভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেল শ্যামার লোভ। কাঁকনের মা শাহানারা মাসীকে বলে আর এক জন্মদিনে আমার আর নিজের জন্য গোলাপি আর শাদা রঙের ববি প্রিন্টের জামা জোগাড় করল সে। পূজায় একটাঈদে একটাদুই বোনের জন্মদিনে একটা করে এই ছিল বছরে আমাদের নতুন জামা। স্কুল ড্রেস ছিল দুই সেট। আর বিকালে নীচে খেলতে যাওয়ার জন্য দুতিনটা জামা। বেড়াতে যাওয়ার জন্যজন্মদিনেনিমন্ত্রণে যাওয়ার জন্য তোলা থাকত আর দু’ একটা জামা। এছাড়া থাকত ফেড হয়ে যাওয়া ঘরে পড়বার জামা। রাস্তায় বের হলে পাতাকুড়ানী ছেলে মেয়েদের খালি গা আর খালি পা দেখে নিজেদের খুব বড়লোক মনে হত। অথচ এই আমেরিকায় টিন এজ মেয়েদের ক্লজেট খুললেই দেখি হুঁড়মুড় করে জামা মাটিতে গড়িয়ে পড়ছে। রাখবার জায়গা নেই। একবারও না পড়েই জামা দিয়ে দিচ্ছে গুড উইলে। কিনবার পরেই আর পছন্দ হয়নি তা।

জন্মদিন পৃথিবীর সেরা দিন। এর মত আর দিন হয় না।

তবে অতিরিক্ত আদরেও একসময় অরুচি ধরে। মনে আছে আঠারো বছরের জন্মদিনে মা যে নতুন জামা পরতে দিয়েছিল তা একপাশে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছিলাম আমি। টীন এজ হয়ে গেছে। বাবামার ভালোবাসাটা লোকজনের সামনে তুচ্ছ করতে শিখে গেছি।

ছেলেবেলার এইসব জন্মদিন ফেলে এসে তারপর অনেক বছর কেটে গেছে। আজকাল কেউ আমার জন্মদিন নিয়ে হুল্লোড় করলে বড় ভালো লাগে। মনে হয় এ আমার দিন। কেবল আমার।

তাই লাল আর হৈ তাথৈ-এর মুখে জন্মদিনের উপহারের কথা শুনে চোখ জুলজুল করে উঠল আমার।লাল করাত শানাবেতাথৈ ছবি আঁকবেহৈ রঙ পছন্দ করবে। মনের মত সব। শিল্পীদের প্রতিভায় বাঁধা দেবএমন অমানুষ তো আমি নই।

লিটল লাইব্রেরী আসলে একটু বড় সাইজের বার্ড হাউজের মত দেখতে। দুই ফুট বাই এক ফুট ছোট একটা ঘর বাড়ির সামনে মাটিতে মেইলবক্সের পোলের হাইটে লাগানো থাকে।

ভারি সুন্দর নকশা করা। জানালা আঁকাদরজা আঁকা। চিমনি আছে। লালহলুদ বা নীল রঙের ওই ঘর। সাদা ভেনিসন ব্লাইণ্ড ঝুলছে। ফ্লাওয়ারবক্স জানালায়। তাতে ছোট ছোট ফুল ফুটে আছে। ডলস্‌ হাউজের মত মনে হয় আমার এই লিটল লাইব্রেরীকে। জলজ্যান্ত স্বপ্ন একেবারে। এই ছোট ঘরগুলোর ভিতর বাড়িতে যে বই এক্সট্রা হয়ে গেছে তা রেখে দেয় মানুষ। পথে চলতে ইয়ার্ডের পাশে রাখা এই বই নিয়ে যায় পাড়া পড়শীপথিক। একটু দাঁড়িয়ে থেকে হয়ত গল্প করে। কখনো শুধু অল্প হাসি। কখনো কিছুই না। শুধু মনের ভিতর ভালো লাগা। আমেরিকার জীবনে সব জিনিষ এত অল্প সময়েই এত বেশি জমে যায়। বই-ও। স্মৃতি আঁকড়ে ধরে থাকবার বাইরেও প্রচুর জিনিষ।

অথচ দেশে দেখেছি মা যত্ন করে রেখে দিয়েছে আমাদের ক্লাশ টু-এর বই। কিছুতেই কাউকে হাতে ধরে দিতে পারে না। রমা শ্যামা ’ লিখতে শিখেছিল সবুজ সাথী থেকে। রমা শ্যামা যে আজ তারপরে ’-ও শিখে ফেলেছেতা ভাবতে ইচ্ছা করে না। চোখ জলে ভরে যায়। প্রত্যেক ভাদ্রমাসে মা সব বই বারান্দায় রোদ দেয়। ঝেড়েঝুড়ে আবার আলমারিতে তুলে রাখে। তবু পোকা কেটে ছোট ছোট ফুটো করে ফেলে বাবুদের তালপুকুরে। তবুও বাড়ির বই কাউকে দিয়ে দেওয়া যেন এক অমার্জনীয় অপরাধ।

এখানের হাফ প্রাইস বই-এর দোকান আর লিটল লাইব্রেরী দেখে তাই আমার ভারি অবাক লাগে। খুব লোভ সেই কবে থেকে এই লিটল লাইব্রেরীর উপর। আহা আমার ইয়ার্ডে যদি একটা বসানো যেত। খোঁজ নিয়ে দেখলাম দেড়শ ডলার মত দাম। কিন্তু লাল আর তাথৈ হা হা করে উঠল। ওরা নাকি বানিয়ে দেবে। এই লিটল লাইব্রেরীই হবে আমার জন্মদিনের উপহার। ওদের সকলের উত্‌সাহ দেখে আমার চোখ জলে ভরে গেল।

বরফ মাটি কামড়ে ধরবার আগেই নাকি তৈরী হয়ে যাবে আমার লাইব্রেরী। আমি স্বপ্ন দেখতে থাকলাম। পড়শিরা কুকুর নিয়ে হাঁটতে গিয়ে আমার বাড়ির পাশে একটু থামছে। আমার লিটল লাইব্রেরী খুলে বই নেড়েচেড়ে দেখছে। সব বই ফ্রী। পছন্দ হলে বই নিচ্ছে। আর আমি বাড়ির সব ঘরে দৌঁড়ে দৌঁড়ে সকলকে জানাচ্ছি, ‘নিয়েছেনিয়েছে।‘ স্বপ্নের ঘোড়ায় রশি টেনে ধরবার কোন ব্যাপারই নেই। আসলে নিঃসঙ্গতা আমেরিকার জীবনের বড় সঙ্গী। যে কোন অজুহাতে কোন মানুষকে একটু কাছে টেনে আনতে পারলে বুকের ভিতরটা যেন পালতোলা নৌকার মত দুলে ওঠে। সমস্ত অস্ত্বিত্ব ঘিরে বয়ে যায় সুবাতাস। আমেরিকায় মানুষকে কাছে টেনে আনা অত সহজ তো নয়। মানুষের কাজ আছে। ফ্রী তে বই দিয়েও তাকে পাওয়া যায় না।

এ বছর আমার পঞ্চাশ বছর হবে। বিরাট মাইলস্টোন। এত বছর ধরে কিভাবে পৃথিবী কাঁপিয়ে রাজত্ব করে গেলাম ভাবছি। ডাইনোসর-রাও মনে হয় এত বছর বাঁচে নি। তবে গত বছর কাঠের তক্তা পেয়েছিলাম। সে তক্তা এখনো লিটল লাইব্রেরীতে নিজের মেটামরফোসিস না ঘটিয়ে গ্যারাজের দেওয়ালে গা এলিয়ে কাত হয়ে পড়ে আছে। আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই। দেখা যাকএ বছর কি পাই।


ম্যাডিসন, ২০১৭



Comments



কল্যাণী রমা-র জন্ম ঢাকায়। ছেলেবেলা কেটেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। ভারতের খড়গপুর আই আই টি থেকে ইলেকট্রনিক্স এ্যান্ড ইলেকট্রিক্যাল কমুনিকেশন ইঞ্জিনীয়ারিং-এ বি টেক করেছেন । এখন আমেরিকার উইস্কনসিনে থাকেন। অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট সিনিয়র ইঞ্জিনীয়ার হিসাবে কাজ করছেন ম্যাডিসনে।
প্রকাশিত বইঃ
আমার ঘরোয়া গল্প;
হাতের পাতায় গল্পগুলো – ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা;
রাত বৃষ্টি বুনোহাঁস – অ্যান সেক্সটন, সিলভিয়া প্লাথ, মেরি অলিভারের কবিতা;
মরণ হ’তে জাগি – হেনরিক ইবসেনের নাটক;
রেশমগুটি;
জলরঙ;
দমবন্ধ।


Popular Posts