দমবন্ধ (২)

ছেলেবেলায় খুব গাজর খেতে ভালোবাসতাম। এখনকার মত নয় । কমলা রঙের কচি কচি মিষ্টি গাজর যেন মাটির নিচের খনি থেকে উঠে আসত। কিন্তু দাদুভাই মনে হয় বাগানের গাজর গুনে রাখত। কেয়াপিয়া আমিশ্যামা আর অন্যান্য বন্ধুরা মিলে গাজর খেয়ে তাই উপরের সবুজ পাতা আবার মাটিতে গুঁজে রাখতাম। কিন্তু দুই তিন ঘন্টা পর নেতিয়ে যাওয়া পাতা দেখে দাদুভাই-এর সেকি উত্তেজনা! মারতে তো আর পারে না। বকাঝকা দিয়েই মানুষ খরগোশদের শায়েস্তা।

বাগানের আলু তোলা সেও এক দক্ষ যজ্ঞ । আমার কবিতা মামী আর মামাতো ভাই অয়ন তখন আমাদের সাথে থাকে। অয়নের জন্ম দুবাই-এ। আমাদের এখানে এসে ক্যাম্পাসে আর পিওন কোয়ার্টারের সামনে চড়ে বেড়ানো ছাগলগরু দেখে আনন্দে আটখানা ও । অয়ন দাদুভাই-এর বাগানে আলু তোলে আর ভাবে মাটি থেকে ডিম তুলছে। টমেটো দেখে টম্মা টম্মা বলে কি চিত্কার তার। দুপুরে টমেটো আর শশা কুচি করে তখন সবসময় বাড়িতে সালাদ করা হতো । দাদুভাই-এর জন্য অবশ্য চাক চাক টমেটো। ছোট্ট অয়ন বাবা মার সাথে আমেরিকায় চলে যাবার পর ওর রেখে যাওয়া জামা কাপড়ের গন্ধ শুকত মা। খাওয়ার টেবিলে বসে কত যে অয়নের সেই টম্মা র কথা। সালাদের লেবুর রস আর পিয়াজ কাঁচা মরিচের ঝাঁঝে নয়টম্মা শব্দটায় চোখ জলে ভোরে উঠত সবার।

আলু তুলে নানা ভাগে রাখা হত। মাঝারিবড়মেজো। আর সবচেয়ে কুচি গুলোর সবচেয়ে নাম ডাক । খোসা সহ দু’ ভাগ করে মুচমুচে করে ভাজা হবে। ঘি এর সাথেঘি এর ছাকার সাথে বা মুশুরির ডালের সাথে খাওয়া হবে। দাদুভাইয়ের বাগানে ছিল বকফুল গাছ। মটরশুটির ফুলকে টেনে ছয় ইঞ্চি মত লম্বা করে দিলে যেমন হবে বকফুল তেমন দেখতে। বুকের কাছে গোলাপি আভা মতো। প্রায় তিরিশ বছর হয়ে গেছে বকফুলের বড়া খাইনা। ছিল সজনে ডাটা-র গাছ। শুনলাম বসন্ত কালে সজনে ডাটা খেলে চিকেন পক্স হবে না। আলু ভেঙে আদা কুচি, পাঁচফোড়ন দিয়ে সজনে ডাটার ঝোল করে দিদা। ঘি তো থাকবেই। ঘি ছাড়া দিদার রান্না হয় না।
পেঁপে গাছজাম গাছআম গাছ - কিছুরই অভাব নেই দাদুভাই এর বাগানে। কিন্তু আমি সবচেয়ে মুগ্দ্ধ হতাম পাটগাছ দেখে। কচি পাটশাকে মুশুরির ডাল ছিটা দিয়ে রান্না হ'ত। তারপরদাদুভাই চললো পাট গাছ নিয়ে নালার জলে ডুবিয়ে রাখতে। সত্যি সত্যি পচিয়ে নাকি পাট হবে। স্বর্ন তন্তু। সোনার আলোয় পাট এলো ঘরে। দাদুভাই তা থেকে রশি পাকাল।
আমি তো হতবাক।

দৌড় দৌড় দৌড়। এ ঘর থেকে ও ঘর। আমি দৌড়াচ্ছিশ্যামা দৌড়াচ্ছে। পিছন পিছন বাতের ব্যথা নিয়ে হেলেদুলে নাদুস নুদুস দিদাও। ঘোল মথিয়ে মাখন করেছে। হাতে মাখন লেগে আছে। তা আমাদের মুখে মাখিয়ে দেবে। মুখের চামড়া তুলতুলে হবে। কিন্তু ডলে ডলে মাখন মাখানোর উতপাতে আমরা তটস্থ। দৌড় দৌড় দৌড়।

Comments



কল্যাণী রমা-র জন্ম ঢাকায়। ছেলেবেলা কেটেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। ভারতের খড়গপুর আই আই টি থেকে ইলেকট্রনিক্স এ্যান্ড ইলেকট্রিক্যাল কমুনিকেশন ইঞ্জিনীয়ারিং-এ বি টেক করেছেন । এখন আমেরিকার উইস্কনসিনে থাকেন। অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট সিনিয়র ইঞ্জিনীয়ার হিসাবে কাজ করছেন ম্যাডিসনে।
প্রকাশিত বইঃ
আমার ঘরোয়া গল্প;
হাতের পাতায় গল্পগুলো – ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা;
রাত বৃষ্টি বুনোহাঁস – অ্যান সেক্সটন, সিলভিয়া প্লাথ, মেরি অলিভারের কবিতা;
মরণ হ’তে জাগি – হেনরিক ইবসেনের নাটক;
রেশমগুটি;
জলরঙ;
দমবন্ধ।


Popular Posts