দমবন্ধ - ৩৭
স্কুল শেষ হ’ল। এবার কলেজে যাওয়ার পালা। এতদিনে আমাদের স্কুলের কলেজ শাখা খুলেছে। সুস্মি, শাওন, লোপা সেখানেই পড়বে। আমি, শ্যামলী, রুনা যাব শহরে রাজশাহী কলেজে। যেন লরা মেরী। গ্রামের ঘর ছেড়ে যাচ্ছি দূরের স্কুলে। হাতে লাঞ্চ পেইল, মাথায় রোদ টুপি।
খুব ভোরে ইউনিভার্সিটির বাসে ক’রে শহরে কলেজ যাওয়া, আর সেই সন্ধ্যায় বাসে ক’রে ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে বাড়ি ফেরা। জোহা চাচার মাজার কিংবা জুবেরি ভবনের সামনে থেকে বাসে উঠি, নামি। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি যতদূর চোখ যায় হলুদ সর্ষে ফুল ফুটে আছে। খেজুর গাছে রসের হাড়ি ঝুলছে। কুয়াশায় ঢেকে আছে চারদিক । কুয়াশারও একটা গন্ধ আছে। স্বপ্নের গন্ধ । রাস্তার পাশে মাটিতে বসে ধূপিপিঠা ক’রে বিক্রী হচ্ছে। চালের গুঁড়ার ভিতরে নারকেল আর খেজুরের গুঁড়।
বাস থেকে নেমে দেখি ফলের দোকান। আঙ্গুর বিক্রি হচ্ছে। বিদেশী ফল বলে এক একটা আঙুরের দাম পঞ্চাশ পয়সা। তখন কি ভালই যে লাগত আমার আঙ্গুর খেতে। প্রিয় ফল যেন। দামের জন্য একটা আঙ্গুর কিনেই মুখের ভিতর টপ করে ফেলে দিতাম। অমৃত! পাশেই কেক- পেস্ট্রির দোকান। কী তুলতুলে সাদা, হালকা সবুজ, হালকা গোলাপি, হলুদ ক্রীম দিয়ে ঢাকা সব কেক। দু'টাকা ক'রে এক একটা পিস্। তখনকার সময়ে অনেক দাম। এত লোভ হ'ত। কিন্তু বাড়ি থেকে বাইরের জিনিস খেতে মানা ক'রা আছে। খেতে পারতাম না ব'লে এখনো সেই কেকের লোভ আমার যায় নি।
শীতকাল। ছোট দিন। যখন বাড়ি ফিরে আসি তখন চারদিক অন্ধকার। এসেই হাতমুখ ধুয়ে মোটাসোটা ফিজিক্স বা কেমিস্ট্রি বই নিয়ে বসি।আমাদের গেস্টরুমের টিমটিমে আলোয় । এইচ এস সি পরীক্ষার আগে খুব অল্প সময় হাতে।ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসে। তবু বই-এর দিকে অপলক তাকিয়ে থাকি। ভালো রেজাল্ট করবার লোভ আমি ছাড়তে পারি না। নেশাও।
১৮৭৩ সালে স্থাপিত রাজশাহী কলেজ । লাল রঙের রাজপ্রাসাদের মত মনে হ’য় আমার কলেজটাকে। সাদা আর হলুদ রঙ্গে কারুকাজ ক’রা লালের উপর। প্রশাসনিক বিল্ডিংটা ব্রিটিশ-ভারতীয় ঔপনিবেশিক স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন। শুনেছি দোতালা এই বিল্ডিংটার চূড়ায় এক সময় রোমান পুরাণের জ্ঞান ও চারুশিল্পের দেবী এথেনার ভাস্কর্য ছিল । প্রশাসনিক বিল্ডিং-এর পিছনে বিরাট পুকুর। পুকুরের পাশে যে কারুকার্যময় বিল্ডিং সেখানে আমাদের অঙ্ক ক্লাশ হ’ত। এত বড় কলেজ ক্যাম্পাস। এক ক্লাশ থেকে আরেক ক্লাশে দৌড়ে দৌড়ে যেতে গিয়ে আমরা হিমশিম খেয়ে যেতাম। কলেজ ক্যাম্পাসে আছে ঐতিহাসিক ‘ফুলার ভবন’। একশ’ বছর পেরিয়ে গেছে তার বয়স। কলেজ মাঠের একেবারে দক্ষিণে অধ্যক্ষের দোতলা বাসভবন। বাসভবনের দক্ষিণ পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পদ্মানদী। আর এর পশ্চিমে হযরত শাহ মখদুম-এর মাজার।
আমাদের বাংলা পড়ান ফরিদা ম্যাডাম, হারুনুর রশিদ স্যার, জিনাত মহল ম্যাডাম। ইংরেজী খালেক স্যার, সরিফুল ইসলাম স্যার, আমীর আলী স্যার, শাহনাজ ম্যাডাম। ফিজিক্স গুহ স্যার, সাইদুর রহমান স্যার। কেমিস্ট্রি কাদের স্যার, ওয়াদুদ স্যার, হাফিজ স্যার। অংক সারওয়ার স্যার। ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছা আমার একেবারেই ছিল না। তাই বায়োলজি না নিয়ে নিলাম স্ট্যাটিস্টিক্স। আসাদ স্যার পড়াতেন।
আমাদের ক্লাশমেট রুহুল, ফরহাদ, জাহিদ, সালাম, মাসুদ, চারু, বিটু, মামুন, জিয়া, হেনা, আলো, তুষার, চুনি, গোলাপ, বজলার, মিতু, রুনি, রুমি, কচি, পাঞ্ছি, শাপলা, সোহেলি, জেবা, রোজী…অসম্ভব স্মৃতিশক্তি রুনার। এই সব কথা মনে আছে ওর।
ইউনিভার্সিটি স্কুলে যখন পড়েছি তখনো তা কো-এড ছিল। মনে আছে একবার কোনদিকের বেঞ্চে বসব তা নিয়ে মেহেদী, টিয়াজ, রুমি সকলের সাথে প্রায় যুদ্ধ বেঁধে গেল । দাদুভাই-এর বাগান থেকে টমেটো সাপ্লাই দিয়েছিলাম আমি। তারপর আমাদের অস্ত্র সেই টমেটো দিয়ে ছোঁড়াছুঁড়ি। শাওন বলল, ‘পোর্ট আর্থার দখল।’
রাজশাহী কলেজও কো-এড। কিন্তু ছেলেদের সাথে আমাদের কোন কথা নেই । কেমন যেন একটু ভয়ে ভয়ে থাকি। কি জানি হবে হয়ত বাড়ির পাশের ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের স্কুলে পড়ে আমরা হয়ত একটু নাজুক ছিলাম। শহরের স্কুল থেকে আসা ছেলেদের সাথে পড়তে গিয়ে আমরা একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিলাম।
সেই সকালে গিয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরা। মাঝে মাঝে মা-দের পিওন বজলুভাই বাড়ি থেকে টিফিন নিয়ে আসতেন। একদম দিদার রান্না ক’রা ডাল, ভাত, মাংস বা মাছ, এমন কি মাঝে মাঝে চাটনি। ভেতো বাঙালী, ভাত খেয়ে মাথা ঠান্ডা থাকত। ভালোমত অংক করতে পারতাম । বজলুভাই-এর বউ কি ভালোই যে ছিলেন। আর অসম্ভব রূপসী। আমাদের বাসায় প্রায়ই আসতেন। আমি অবাক হ’য়ে ওঁনার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। নিষ্পাপ সৌন্দর্য মন টানে। বেশ কয়েক বছর আগে বজলু ভাই মারা গেছেন।
আমাদের ক্লাশমেট রুহুল ১৯৮৩ সালে এস এস সি তে ৮৫৫ নম্বর, ১৯৮৫ সালে এইচ সি তে ৯৩৮ নম্বর পেয়ে প্রথম হয়েছিলো। সব বোর্ডের মধ্যে ওর নাম্বার বেশী ছিল। আর এস এস সি তে ও শুধু প্রথমই হয় নি। যেখানে ৬টা লেটারের বেশি আমরা কেউ পাইনি, সেখানে রুহুল পেয়েছে ৭টি। তখন ইংরেজীতে রুহুল ছাড়া আর কাউকে লেটার পেতে দেখিনি। অসাধারণ মেধাবী মীর মোঃ রুহুল কবির লিটন। আমাদের পরিচিত ধারণায় ফার্স্টবয় বলতেই যে ভীষণ শান্তশিষ্ট একটা চেহারা ভেসে ওঠে, রুহুল মোটেও তেমন ছিল না। ওর দুরন্তপনাগুলো ছিল অভিনব। আমরা কিছুতেই ভেবে পেতাম না ও কখন পড়াশোনা করে। শীতের ভোরে কাঁপতে কাঁপতে স্ট্যাটিস্টিক্স ক্লাশ করতে যাওয়া, ভাঙ্গাচোরা কেমিস্ট্রি গ্যালারিতে বসে লেকচার শোনা, দীঘির পাড়ের লাল বিল্ডিং-এ অংক ক্লাশ করা, ফিজিক্স গ্যালারীতে বীট পড়ানোর সময় রুহুলদের ধুপধাপ পালিয়ে যাওয়া অথচ কোন প্রশ্ন ধরলে সকলের আগে রুহুলেরই পড়া বলা, কলেজের ক্লাশ শেষে এক ব্যাচে প্রাইভেটে অঙ্ক, ফিজিক্স, কেমিসস্ট্রি পড়া - রাজশাহী কলেজের প্রতিটা দিন এভাবেই কাটত আমাদের।
রুহুলের সাথে শেষ দেখা ঈদের সময় একরাতে রাজশাহী নিউমার্কেটের দোতলায়। ও তখন বুয়েটে পড়ে। রুহুল, জাহিদ সবাই ছিল । আমি দেখিওনি, হঠাতই অন্ধকারের ভিতর থেকে রুহুল ডেকে বলল – এই যে রমা। তারপর অন্যান্য বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বলল- দেখ্ , রমা কেমন এটমিক এনার্জি কমিশনে চাকরি করছে। আর আমরা যে কবে পাশ করব? দেশের বাইরে পড়েছিলাম বলে আমি চাকরি শুরু করে দিয়েছি, কিন্তু ওরা তখনও সেশনজটে বুয়েটে। রাজশাহী ইউনিভার্সিটিতে তো চার বছরের কোর্স শেষ করতে আট বছর লাগত। সময়ের কী অপচয়, জীবনের কী অপচয়।
তারপর হঠাত বাড়িতে টিভির ঘরে হৈ চৈ শুনে চমকে উঠলাম। বুয়েটের তড়িৎ কৌশল অনুষদ থেকে দেয়া বিদায় অনুষ্ঠান শেষে রুহুলরা নয় বন্ধু বুড়িগঙ্গায় গিয়েছিল নৌ-বিহার করতে। বৌদ্ধপূর্ণিমার রাত ছিল সেটা। ওদের নৌকার সাথে ধাক্কা লাগে ট্রলারের। মারা যায় রুহুল। অত অল্প বয়সে আমাদের বন্ধুদের মধ্যে আর কেউ চলে যায় নি। অসম্ভব ভালো গান করত ও । মৃত্যুর কিছুদিন আগে বুয়েটের এক অনুষ্ঠানে গান শুরু করবার আগে জানি না কেন রুহুল বলেছিল এটাই আমার শেষ গান,
Comments
Post a Comment