রিফিউজি ঘরে খিদে পাওয়া শিশু
পেটগুলো সব ফুলে ফেঁপে ওঠে
দিশেহারা মা কার কাছে ছোটে।
পূর্ব বাংলা কোলকাতা চলে ।।”
-মৌসুমী ভৌমিক
আমরাও চলেছি। মা এক শাড়িতে, বাবা লুঙ্গি পড়ে, আমি বাবার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে, শ্যামা মার্ কোলে। এক কাপড়ে বেরিয়ে পড়েছি আমরা। মা'র পেটিকোটে বিয়ের গয়না বাঁধা। বড় সুন্দর সে গয়না। ঝলমল ক'রে। দাদুভাই সোনার বার কিনে তা দিয়ে বড় মেয়ের গয়না গড়িয়েছিল।
আমাদের আর ঘর নেই। আমরা বাচঁতে চাই। পাকিস্তানিরা ছুটে আসছে পিছনে। গ্রামে কিছু ঘরে আমাদের আশ্রয় দিল। অজানা মানুষের ভালোবাসা আমাদের বাঁচিয়ে রাখল । মাও শ্যামাকে বাঁচিয়ে রাখতে গুঁড়া দুধে জল মিশিয়ে মিশিয়ে খাইয়ে গেল । ওর চেহারা হয়েছে বায়েফ্রার বাচ্চাদের মত। বড় বড় চোখ, বিরাট মাথা, হাত পা কাঠি কাঠি। আরো পথ যেতে হ'বে।
গ্রামের মানুষ বেত কাঁটা ছড়িয়ে রেখেছে ফসলের মাঠে। কি করবে তা না হ'লে? লক্ষ লক্ষ মানুষ ফসলের মাঠ মাড়িয়ে, মৃত্যু মাড়িয়ে ভারতে চলেছে।
নিজ দেশ আর ভারতের বিভিন্ন গ্রামে নানা অজানা, অচেনা বাড়িতে থেকে অবশেষে আমরা গিয়ে পৌঁছালাম জলপাইগুঁড়ির মালবাজারে।। মার পিসির বাড়ি। দাদুভাই-এর একমাত্র বোন। বড় আদরের ছোটবোন। আমাদের চারজনকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন দিদা। দাদু, দিদা, সাধনা মাসি, কল্যাণী মাসি, ভবানী মাসি, শিবানী মাসি, শংকর মামা আমাদের জন্য কি করবে ভেবে পায় না। পাঁচ মাস কাটিয়ে দিলাম ওনাদের বাড়িতে আমরা। আমাদের কিছু নেই। আমাদের গায়ের জামা বাদে অন্য জামা-কাপড় নেই। পয়সা নেই। দাদু দিদা সবকিছুর ভার নিলেন। এইসব মানুষের ঋণ কিভাবে শোধ ক'রা যায়? মৃত্যু থেকে বাঁচিয়ে যারা আশ্ৰয় দেয়? সব দায়িত্ব নেয়? আমাদের জন্য ওদের ঘরে কিংবা মনে জায়গার অভাব হয়নি।
যুদ্ধর বোমারু বিমানের কথা মনে পড়ছে, মৃত্যুর কথা মনে পড়ছে, দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার কথা মনে পড়ছে, ব্ল্যাক-আউট -এর কথা মনে পড়ছে। সেই সাথে আমার একটা শ্রাদ্ধ বাড়ির কথাও বড় মনে পড়ছে । বহুদিন কোন উৎসবে যাইনি। ভবানী মাসিদের প্রতিবেশীর বাড়িতে শ্রাদ্ধ। আমার তো উৎসব বলে মনে হ'ল। চার বছর বয়সের যে জীবনে যুদ্ধ দাগ কেটে যায় সেখানে খাওয়া দাওয়া মানেই উৎসব, তা সে শ্রাদ্ধের খাওয়াই হোক বা না কেন। কলাপাতা পেতে খেতে বসেছি। শেষপাতে রসগোল্লা দিয়েছে। সাথে দই।
শ্যামাটা এত আস্তে খায়। কিছুই খেয়ে উঠতে পারে না। মা তাড়া দিয়ে যাচ্ছে। ‘তাড়াতাড়ি মাছ টা খাও’। এক বয়স্ক মহিলা বললেন, 'বাচ্চা মানুষ, যতটুকু পেটে ধরে, ততটুকুই তো খাবে।' অপমানে মা'র ফর্সা মুখ লাল হ'য়ে উঠল।
'৭১ এর এই ঘটনাটার কথা যখনই ভাবি মা'কে আমার "সর্বজয়া" ব'লে মনে হ'য়।
 |
মা আর আমি - ১৯৬৭ |
[ বিংশ
শতাব্দীর অন্যান্য ভয়ংকর জেনোসাইডগুলির মধ্যে “১৯৭১ বাংলাদেশ জেনোসাইড” এক প্রধান হত্যাযজ্ঞ। পৃথিবীর ইতিহাসে
এত অল্প সময়ে এত হিংস্রতা আর খুব কমই দেখা গেছে। “১৯৭১ বাংলাদেশ জেনোসাইড”-এ ৪০০,০০০ বাংলাদেশী নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে, তিন মিলিয়ন মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, দশ মিলিয়ন মানুষ রিফিউজি হয়েছে, তিরিশ মিলিয়ন সাধারণ মানুষ নিজেদের ঘর-বাড়ি হারিয়েছে, আর স্বাধীনতার প্রাক্কালে
পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে ইতিহাসের পাতায় নজিরবিহীন, নৃশংস বুদ্ধিজীবি হত্যা।
মুক্তিযুদ্ধের
শেষের দিকে যখন পাকিস্তান বাংলাদেশের(তখনকার পূর্ব-পাকিস্তান)কাছে হেরে যাচ্ছিল, তখন পাকিস্তানি আর্মি স্থানীয় আল-বদর, রাজাকার, আল-শামস এর সহযোগিতায়
বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করতে শুরু করে। এই জঘন্য পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ছিল
এই যে যদি বাংলাদেশ একটি নতুন দেশও হয়, তবু এই নতুন রাষ্ট্র
কোনদিন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে না। আল-বদর, রাজাকার, আল-শামস পথ দেখিয়ে নিয়ে
গেছে পাকিস্তানি আর্মিকে আর তারপর তারা স্বাধীনতার ঠিক প্রাক্কালে নির্বিচারে
হত্যা করেছে বাংলাদেশের ডাক্তার, ইঞ্জিনীয়ার, আইনজীবি, অধ্যাপক, সাংবাদিক, ঔপন্যাসিক, চিত্রশিল্পী, সুরকার, নাট্যকার, লেখক এবং কবিদেরকে।
যাঁদের মৃতদেহ পাওয়া গেছে তাঁদের চোখ ছিল কাপড় দিয়ে বাঁধা, হাত ছিল পিছনে মোড়া - সারা শরীরে ছিল
তাঁদের অত্যাচারের চিহ্ন। “১৯৭১ বাংলাদেশ জেনোসাইড”-এ মানুষকে জ্যান্ত কবরে পুঁতে ফেলা হয়েছে। এত মৃত্যু, এত রক্ত, এত আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমাদের স্বাধীনতা - “১৯৭১ বাংলাদেশ জেনোসাইড”-এর পরিসংখ্যান
বিশ্বকে স্তম্ভিত করে দেয়। খোলা মাঠে, ইঁটের ভাটায়, জলের পাম্পের পাশে পড়ে থেকেছে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবিদের মৃতদেহ – পুকুর আর নদীতে ‘পানার মত’ মানুষের মুন্ডুহীন শরীর ভেসে গেছে। বহু মৃতদেহ খুঁজেও পাওয়া যায়
নি।
আমরা বাবার মৃতদেহ পেয়েছিলাম। বাবা
ঢাকায় বুয়েটে কেমিক্যাল ইঞ্জিনীয়ারিং ডিপার্টমেন্টে শিক্ষকতা করতেন। তখন মা’র বয়স
ছিল সাতাশ। আমার বয়স চার। আমার ছোট বোন শ্যামার* বয়স দেড়। বাবা মারা যাওয়ার প্র মা
ইংল্যান্ড থেকে পি এইচ ডি শেষ করে আমাদের দুই বোনকে মানুষ করেছে। মা বাকি জীবন
একাই কাটিয়েছে - নিজের পায়ে দাঁড়ানো, সারা জীবন মাথা উঁচু করে চলা এক
বাংলাদেশি নারী।
*শ্যামা
এখন ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যানেজার হিসাবে ইন্টেল, পোর্টল্যান্ড, ওরাগনে
চাকরি করছে। ও ভি এল এস আই চিপস ডিজাইন করে।
**সর্বকালের
একজন অন্যতম চলচ্চিত্র নির্মাতা, অস্কার বিজয়ী সত্যজিত রায়ের প্রথম
পরিচালনা্, ১৯৫৫ সালের সাড়া জাগানো চলচ্চিত্র ‘পথের
পাঁচালি’-র ‘মা’ চরিত্রের
নাম ‘সর্বজয়া’। সুবিখ্যাত বাঙালি কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ১৯২৯ সালে লেখা উপন্যাস ‘পথের পাঁচালি’-র উপর ভিত্তি করে চলচ্চিত্রটি করা হয়।]
Comments
Post a Comment