দমবন্ধ - ৩৩

(৩৩)
অসম্ভব গরম পড়েছে। বেগুনি রঙের জারুল ফুল ফুটে আছে।  টিনের চালের স্কুল আর দ্বিতীয় কলাভবনের মাঝখানে সারি বেঁধে জারুল গাছের সারি।  ফুলগুলোর পাপড়ি নরম টিস্যু  পেপারের মত।  প্রচন্ড গরমে বছরে একবারই ফোটে জারুল ফুল।  কলিটা ফেটে হঠা 'রে যেন পুটুস ক'রে ফুটে ওঠে ফুল। 
যখন গরম আর সহ্য করা যাচ্ছে না ঠিক তখন বৃষ্টি নামল।  টিনের চালে ঝম ঝম শব্দ। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ ভুলে যাওয়া স্বপ্নের মত মনে হয়। অন্ধকার  'যে গেছে  ক্লাসরুম।  আল মাহমুদ স্যার ফিজিক্স পড়াচ্ছেন। ল্যাবরেটরিতে ব্যাঙ কাটা শেখাচ্ছেন অনু স্যার। ভদ্র স্যার হয়ত অংক করাচ্ছেন। হেডস্যার বলছেন বাংলা রচনায় সব সময় কোটেশন দেওয়া চাই।
এই আমাদের স্কুল।  রাজশাহী ইউনিভার্সিটি এক্সপেরিমেন্টাল স্কুল।  রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষামূলক শিক্ষায়তন। হ্যাঁ সত্যিইউনিভার্র্সিটির ভিতর এক এক্সপেরিমেন্ট হিসাবেই শুরু হয়েছিল এই স্কুল ইউনিভার্র্সিটির টিচারদের ছেলে মেয়েদের  জন্য।
শহরের অন্যান্য বিখ্যাত সরকারি স্কুল থেকে একটু আলাদা স্কুলটা  আলাদা পি.এন স্কুলহেলেনাবাদ স্কুল কলেজিয়েট স্কুলশিরোল স্কুল থেকে।  ম্যাট্রিক পরীক্ষায় কোন সাজেশন পাওয়া যায় না আমাদের স্কুলে।  কোন চ্যাপ্টার ইমপরট্যান্ট তা কোন স্যার বা আপা বলে দেন না।  বই এর এ মাথা থেকে শেষ পর্যন্ত  পড়তে হয়।  মাঝে মাঝে ইউনিভার্র্সিটির টিচার রা এসে ক্লাস নেন।  ইউনিভার্র্সিটির অসম্ভব প্রতিভাবান তরুণ শিক্ষক তরফদার চাচা এসে কেমিস্ট্রি পড়িয়ে যান।  আমরা শিখি কেমিস্ট্রি  শুধু মুখস্ত করবার জিনিস নয়।
কিছুদিন আগে আমাদের স্কুলের পঞ্চাশ বছর পূর্তি অনুষ্ঠান হ'ল। তার পত্রিকায় বন্ধুপ্রতিম নাজ(নাজনীন সুলতানা) একটা অসাধারণ লেখা লিখেছে  তার কিছুটা তুলে না দিয়ে পারছি না।
টিন শেড স্কুলের গাড়ি বারান্দাআর প্রথম সারি ও দ্বিতীয় সারি রুমগুলোর মাঝে ছিল সামান্য ফাঁকা জায়গা। ক্লাশ শুরুর আগে বা টিফিনের সময় বন্ধুরা মিলে সেখানে নিয়মিত কুমির তোর জলে নেমেছিখেলতাম।
আমরা যারা পূর্বপাড়া থেকে যেতাম তারা টিফিনের সময় ক্লাশ রুমে সবার টিফিন বক্স এক সাথে খুলে সবাই মিলেমিশে খেতাম। হাতে বানানো আটার রুটিসাথে আলু ভাজা বা ডিম ভাজাশুকনো মিষ্টিফল -এসবই ছিল আমাদের নিত্যদিনের খাবার। স্কুলের পাশে বিক্রি হত লোভনীয় তেঁতুলের আঁচারবরফ। শুধু পানির বরফের দাম ছিল ১০ পয়সাআর সামান্য দুধ দেওয়াআগায় নারিকেলের কুঁচি বসানো আইসক্রিমের দাম ছিল ২৫ পয়সা। কখনও কখনো কাঁচা আম ক্লাশের দরজার ফাঁকে চাপ দিয়ে থ্যাতলানো অবস্থায় লবন ছিটিয়ে খেতাম।
আমাদের 'কুমির তোর জলে নেমেছিখেলায় কুমির জলে থাকত মানে থাকত বারান্দার নিচে মাঠে।  আর আমরা সব বারান্দায়।  তারপর কুমিরের এপাশওপাশ দিয়ে কুমিরকে লোভ দেখিয়ে জলে নামতাম। আর ছড়া কাটতাম, ‘কুমির তোর জলে নেমেছিকুমির তোর জলে নেমেছি।কুমির ছুঁয়ে দিলেই যাকে ছোঁবে সে তখন নতুন কুমির।
ছেলেবেলায়  এমন কত যে খেলা খেলতাম আমরা। আমার ছোটমাসীর মেয়ে প্রভার সাথে গল্প করছিলাম সেদিন এই খেলাগুলো নিয়ে। ও আমার থেকে অনেক ছোট। কিন্তু ওরাও হলিক্রস স্কুলে খেলত এসব খেলা। এতদিন পর খেলাগুলো ঠিকমত মনে নেই আমারপ্রভার কাছে শুনে আবার ফিরে এল ছেলেবেলা। যদিও বেশীর ভাগ খেলাতে সবাই আমাকে মিল্ক রাইসকরত। দুধ ভাত।আমি কাউকে ছুঁয়ে দিলেও কিছু যায় আসে না, কেউ আমাকে ছুঁয়ে দিলেও কোন লাভ ক্ষতি নেই । চিরকালীন এলেবেলে । আসলে স্কুলের পড়াশোনাটা আমি করতে পারতাম, খেলাধূলা একেবারেই না। কিন্তু খুব ইচ্ছা ছিল কেউ আমায় দলে নিক, আমাকেও কেউ খেলোয়াড়ের সম্মান দিক । জীবনে সব ইচ্ছা কি পূরণ হয়? ‘মিল্ক রাইসআর দুধ ভাতহয়েই কেটে গেছে আমার স্কুল জীবন।
মনে পড়ছে "এল ও এন ডি ও এন লন্ডন" খেলাটার কথা । লীডার উল্টোদিকে মুখ ক'রে দাঁড়িয়ে থাকত।  আমরা আড়াআড়ি লাইন ক'রে পিছনে।  লীডার বলত টানা সুরে, "এল ও এন ডি ও এন লন্ডন" সে কথার ফাঁকে আমরা এক পা এক পা করে এগিয়ে যেতাম । তারপর লীডার ঘুরে দাঁড়ানোর আগে নড়াচড়া না করে শান্ত হয়ে, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়তে হ'ত। লীডার ঘুরে যদি কাউকে নড়তে চড়তে দেখত সে আউট। আর যে এক পা এক পা করে এগিয়ে লীডারকে ছুঁতে পারবে তখন সেই হত নতুন লীডার ।
খেলতাম টি টি টি তোমার কি রং চাই?’ ‘টি টি’-র বাংলা ক’রে চাচা তোমার কি রঙ চাই?’ একজন চোর হ’ত। এ খেলায় দলে অনেক লোক থাকত । আমরা সবাই চোরকে ঘুরে ঘুরে সুর ক’রে বলতাম টি টি টি তোমার কি রং চাই?’ ‘চাচা তোমার কি রঙ চাই?’ হাত পা নেড়ে ভেংচি কেটে নানা রকম নাচানাচি করতাম । তারপর চোর কোন একটা রঙ বললেই সেই রঙ খুঁজতে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিতাম আমরা। রং খুঁজে পাওয়ার আগে যদি কাউকে ছুঁয়ে দিত চোর তবে সে তখন হ’ত নতুন চোর।  
স্কুলে নানা রঙ খুঁজে পেতে একটু মুশ্‌কিল হ’ত যদিও। আমরা স্কুল ড্রেস পড়ে থাকতামনানা রঙের পোশাকের সুযোগ নেই। ছোট ক্লাশে মেয়েদের নেভী ব্লু স্কার্টসাদা শার্ট। গলায় সাদা স্কার্ফ। ছোট ছেলেদের নেভী ব্লু হাফ প্যান্টসাদা শার্ট । বড় ছেলেদের নেভী ব্লু ফুল প্যান্টসাদা শার্ট । সাদা কেডস সকলের। সাদা চক দিয়ে ঘষে ঘষে সাদা রং করতাম তা। কালো চামড়ার জুতাও ছিল। কিন্তু পি টি ক্লাশের দিন কেডস পড়ে আসতে হ’ত। বড় ক্লাশের মেয়েদের নেভী ব্লু টিউনিকসাদা শার্টসাদা সালোয়ারসাদা স্কার্ফ সাদা বেল্টকড়কড়ে মাড় দেওয়াফোল্ড করে ইস্ত্রি ক’রা সাদা ওড়না । অবশ্য আমাদের টিফিন বক্স আর স্কুলের ব্যাগে রঙের অভাব ছিল না । স্কুলের স্যার আপাদেরও তো আর স্কুল ড্রেস ছিল না। কিন্তু টি টি টি তোমার কি রং চাই’ বলে ওঁনাদের ছোঁবার সাহস আমাদের কোনদিন হ’ত না।
আমাদের গলার সাদা স্কার্ফ খুব কাজে আসত রুমাল চুরি খেলা আর কানা মাছি ভোঁ ভোঁ খেলা খেলবার সময়ও।
রুমাল চুরি খেলায় সবাই গোল হ’য়ে চোখ বন্ধ ক’রে বসতাম । একজন চোর হ’ত। কোন একটা জনপ্রিয় গান করতে থাকতাম । গান চলবার সময়ে চোর রুমাল অর্থা গলার স্কার্ফটা বসে থাকা কারো পিছনে খুব সন্তর্পণে রেখে দিত। যদি সে সাথে সাথে বুঝতে পারত তার পিছনে রুমাল রাখা হয়েছেতবে উঠে চোরকে ধরতে পারলে সে তখন নতুন চোর হ’ত আর চোর তার জায়গায় বসে পড়ত । তা না হ’লে গান শেষ হ’লেঘুরে ঘুরে চোর এসে যার পিছনে রুমাল আছে তার পিঠে টোকা দিত। সে তখন উঠে চোরের পিছনে দৌঁড় দৌঁড়। চোরকে ছুঁতে হবে। আর চোরও দৌঁড়াচ্ছে তার খালি জায়গা টা নেওয়ার জন্য। চোরকে ছুঁতে না পারলে সেই তখন হ’বে নতুন চোর।
গলার স্কার্ফ কাজে আসত কানামাছিখেলাতেও । সবাই গোল হয়ে দাঁড়াতাম। মাঝখানে একজন চোখে স্কার্ফ বেঁধে। সেই হচ্ছে কানামাছি’  আমরা আমাদের গোলটার পরিধি আস্তে আস্তে বড় করতে থাকতাম । কানামাছিআমাদের ছোঁওয়ার চেষ্টা করত । আর আমরা সুর করে করে ছড়া বলতাম, ‘কানামাছি ভোঁ ভোঁ যাকে পাবি তাকে ছোঁ।আর কানামাছির গায়ে টোকা দিতাম । যদি কানামাছিচোখ বাঁধা অবস্থায় কাউকে ছুঁয়ে তার ঠিক ঠিক নাম বলতে পারত তবে সে হত নতুন কানামাছি।
আমাদের খুব প্রিয় খেলা ছিল ওপেনটি বায়োস্কোপ দুই দলের রাজা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দুহাত উঁচু করে ধনুকের মত করত। তার ভিতর দিয়ে আমরা সবাই কাঁধে হাত দিয়ে লম্বা লাইন করে ঘুরে ঘুরে যেতাম । সেই সাথে সুর তুলে গান করতাম
ওপেনটি বায়োস্কোপ
নাইন টেন টেইস্কোপ
সুলতানা বিবিয়ানা
সাহেব বাবুর বৈঠক খানা
সাহেব বলেছে যেতে
পান সুপারি খেতে
পানের আগায় মরিচ বাটা
ইস-স্প্রিঙের চাবি আঁটা
যার নাম রেনু বালা গলায় দিলাম মুক্তার মালা।
গলায় দিলাম মুক্তার মালা বলে যে সে মুহুর্তে ধনুকের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল তাকে ধরে ফেলা হত। রাজারা তাকে জিজ্ঞাসা করত সে কোন দলে যাবে। এইভাবে সবাই একে একে ধনুকে ধরা পড়ে নিজেদের দল ঠিক করে নিত। তারপর আসল মজা। দুইদলে দড়ি টানাটানির মত টানাটানি খেলা হত। দড়ি ছাড়াই। কোন দল জিতল?
এখনো মাঝে মাঝে স্বপ্নের ভিতর ফুল টোক্কা খেলাটার কথা মনে পড়ে। কে যেন বলছে, ‘আয় রে আমার টগর’ ‘আয়রে আমার বেলী। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আজান এই বুঝি দিল। তবু আয় রে আমার টগর
ফুল টোক্কা খেলাটা দাবা খেলায় বোড়ের এগিয়ে যাওয়ার মত। দুদলে খেলা হবে। দুদলে দুটো রাজা থাকবে । প্রত্যেক রাজা তার দলের সকলের এক একটা করে ফুলের নাম দেবে। দল দুটো মুখোমুখি লম্বা লাইনে বসবে । এক দলের রাজা অন্য দলের কাছে গিয়ে একজনের চোখ দুহাত দিয়ে ঢেকে নিজ দল থেকে ডাকবে, ‘আয় রে আমার টগরকিংবা আয়রে আমার বেলী। তখন টগর বা বেলী এসে কপালে টোকা দিয়ে যাবে। রাজা যখন চোখ খুলে দেবে, তখন বলতে হবে কাকে ডেকেছিল । ঠিক বলতে পারলে এক লাফে যতদূর এগোতে পারে ততদূর যাবে । ঠিক বলতে না পারলে যে টোকা দিতে এসেছিল সে লাফ দিয়ে অন্য দলের দিকে যতদূর যেতে পারে যাবে। এভাবে যে দল আগে অন্যদলকে পার করে যেতে পারবে সেই দল জিতবে ।
ইঁদুর, বিড়াল খেলায় একজন ইঁদুর হবে, একজন বিড়াল হবে। বাকি সবাই হাতে হাত ধরে ধরে গোল হয়ে দাঁড়াবে। সবাই ইঁদুরের পক্ষে। ইঁদুর ভিতরে থাকবে, বিড়াল বাইরে। বিড়াল হাতের ভিতর দিয়ে হোক যেভাবে হোক ভিতরে ঢুকে ইঁদুর ধরবার চেষ্টা করবে। সবাই বাঁধা দেবে। ইঁদুর ধরা যাবে না । ইঁদুরকে বাঁচানো চাই।
আরো কত খেলা। ইচিং বিচিং চিচিং চা, প্রজাপতি উড়ে যা দুজন মাটিতে পা ছড়িয়ে বসত পায়ের পাতায় পায়ের পাতা লাগিয়ে। অন্য দুজন ইচিং বিচিং চিচিং চা, প্রজাপতি উড়ে যা বলে ঘুরে ঘুরে লাফ দিত সে দুই পার ফাঁকে।
দড়ি টানাটানি খেলা আমরা এমনি খেলতাম না। কিন্তু সবসময় দড়ি টানাটানি খেলা থাকত স্কুলের স্পোর্টস ডে তে। আহা স্পোর্টস ডেলাল নীল কাগজে তিন কোণা ফ্ল্যাগ বানিয়ে ময়দা দিয়ে আঠা করে সেই ফ্ল্যাগ চিটানো হত দড়িতে তারপর সেই ফ্ল্যাগওয়ালা দড়ির মালা চারদিকে ঝোলানো হ দড়ি টানাটানিতে ক্লাশ নাইনের উল্টোদিকে ক্লাশ টেন বা স্যারদের বিপরীতে আপারা। দড়ির মাঝখানে একটা রুমাল বাঁধা থাকত। তার দুপাশে দুদল। যে দল টেনে অন্য দলের সবাইকে নিজেদের দিকে নিয়ে আসতে পারবে সে দলের জিত। আপারা জিততে পারল না স্যাররা জিততে পারল তা নিয়ে ভীষণ হুল্লোড় পড়ে যেত আমাদের মধ্যে
যখন এসব দেশজ খেলা খেলতাম নাআমরা খেলতাম স্কুলের মাঠে ব্যাডমিন্টন যদিও আমি ব্যাডমিন্টন পর্যন্ত খেলতে পারতাম না। মনে মনে যদিও সবসময় ভাবতাম খেলাতেও আমি ট্রফি পাব । আসলে স্কুলে মনে হয় শুধু দাবা খেলায় আমি পুরস্কার পেয়েছিলাম তাও দাবার পুরস্কার স্পোর্টস ডে তে মনে হয় দেয় নি । কালচারাল অনুষ্ঠানের বিতর্ক প্রতিযোগিতা , আবৃতি এইসবের সাথে দিয়েছিল। অথচ স্পোর্টসের মাঠে সকলের সামনে দিয়ে গর্বভরে হেঁটে গিয়ে পুরস্কার নেওয়ার কত যে লোভ ছিল আমার! আর সেই ভিক্টরি স্ট্যান্ড! আহা!
সময়ের অভাবে যে সব  খেলা আমরা স্কুলে খেলতে  পারতাম  না  তা  খেলতাম  বাড়ি  গিয়ে  বাড়ির সামনের মাঠে খেলতাম দাঁড়িয়া বাঁধা, নুনা বদন, বৌচিটিপু, মোরগ লড়াইগোল্লাছুট, টিলো এক্সপ্রেস, হা ডু ডু সিঁড়িঘরে লুকোচুরি।লিসাদের বাড়ির সামনের পার্কে গাছ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঝাঁই ঝাপ্পা কানাই মাছি। বারান্দায় খেলতাম কিত্  কিত্এক্কা দোক্কা  ছেলেরা খেলত গুলিলাট্টূউড়াত ঘুড়ি বন্ধুদের সাথে ধাক্কাধাক্কি করে খেলে হাঁটুর আর কনুই-এর চলটা উঠিয়ে ফেলেছিলাম আমরা। আমাদের ভিডিও গেম ছিল না । 
এখনো খুব মনে পড়ে টিপু খেলার কথা। দুই দল হত। দল দুটো নিজেদের মধ্যে কয়েক গজ দূরে দাঁড়াত । মাঝখানে পিরামিডের মত করে সাতটানয়টা বা এগারোটা পাথর সাজিয়ে রাখা হত। প্রথম দলের থেকে একজন একটা বল দিয়ে পিরামিডের দিকে ছুঁড়ে মারত। যদি পিরামিডটি ভাংতে পারে। তিনবার সুযোগ দেওয়া হত । যদি সে পিরামিড ভাংতে না পারে তখন দ্বিতীয় দল চেষ্টা করত । আর যদি প্রথমদলের জন পিরামিড ভাংতে পারল কিন্তু দ্বিতীয় দলের কেউ বল মাটি ছোঁওয়ার আগে তা ধরে ফেললতবে দ্বিতীয় দলের টার্ন এসে যেত। তারা তখন পিরামিডে বল ছুঁড়বে। আর যদি দ্বিতীয় দলের কেউ বল্ টা ধরতে না পারেতবে তাদের কাজ হবে প্রথম দল যেন আবার পিরামিড বানাতে না পারে তা দেখা। দ্বিতীয় দল বল ছুঁড়ে ছুঁড়ে প্রথম দলের কাউকে ছুঁতে পারলে তারা হেরে যাবে। আর যদি প্রথম দলের কাউকে বল ছুঁতে না পারে আর তারা পিরামিড সাজাতে পারে তবে তাদের আবার টার্ন হবে পিরামিডে বল ছোঁড়ার। আর তা না হলে দ্বিতীয় দলের টার্ন এসে যাবে। পিরামিড সাজিয়ে আমরা তারস্বরে সুর করে বলে উঠতাম টিপু
আর সেই যে মোরগ লড়াই? ডান হাত পিছনে নিয়ে গিয়ে বাম পায়ের গোঁড়ালি ধরতে বে  তারপর পিঠের পিছন দিক দিয়ে বাম হাত নিয়ে গিয়ে ডান হাত ধরতে হ’বে। তারপর অন্য দের পাশে ঘুরে ঘুরে একজন আর একজনকে ধাক্কা দিতে হবে। ধাক্কা খেয়ে যার হাত বা পা আর মোরগের ভঙ্গীতে থাকবে না, সে আউট। শেষ পর্যন্ত যে মোরগের মত থাকতে পারবে সেই জিতবে।
কাচের মার্বেল দিয়ে গুলি খেলা  ছেলেরাই বেশি খেলত আর আমি অবাক য়ে  মার্বেলগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতাম  মসৃণ কাচের মার্বেল নীলসবুজসাদা বা লাল রঙের  ভিতরে সাদাহলুদ , নীল বাবল মত  আমি খালি ভাবতাম কিভাবে ওই সাদাহলুদ নীল রং মার্বেলের ভিতরে গেল 

মাটিতে পায়ের গোড়ালি দিয়ে একটা ছোট গর্ত করা  নীচু য়ে বসে আঙ্গুল ধনুকের মত রে মার্বেল ছুঁড়ে দিতে  গর্তে নিজের গুলি দিয়ে গর্ত থেকে অন্যদের গুলি সরাতে   আর যে প্রথম নিজের সব গুলি ওই গর্তের ভিতর ছুঁড়তে পারত সে জিতে যেত আর সব গুলি পেত 
ছেলেরা ছাদে উঠে লাল, নীল ঘুড়ি দিয়ে আকাশটা ছেয়ে ফেলত। আমার বড় লোভ হত। কিন্তু মেয়েরা ঘুড়ি উড়ায় না। আমি পাশে দাঁড়িয়ে দেখতাম ওরা কাচের গুঁড়ো করে তা দিয়ে মাঞ্জা বানাচ্ছে। সূতায় লাগিয়ে তা দিয়ে অন্যের ঘুড়ি কাটাকাটি করছে। দিদা সবসময় বলত ছাদের কার্নিশের কাছে যাবি না। আকাশে চোখ রেখে কার্নিশ টপকে মাটিতে পড়ে যাবি। বয়স্কদের কথা না শুনে কতবারই আমরা জীবনের কার্নিশ টপকে পড়েছি, আকাশে উড়ে গেছে নানা রঙের ঘুড়ি।


ফটোগ্রাফার : শাহনাজ পারভীন  

(৩৪)
নাজের লেখা থেকে টিফিনের আলুভাজার কথা মনে হল। একজন বলেছিল প্রত্যেক বাসার আলুভাজা আলাদা আলাদা। কথাটা সত্যি। শুধু গোঁফ’ নয়আলুভাজা দিয়েও মানুষকে যায় চেনা। ভোরবেলা আয়েশা বুবু এসে আমাদের বাসায় আলুভাজা আর সিদ্ধ আটার নরম তুলতুলে রুটি বানাত। আলুভাজার গায়ে ডিম ছিটানো থাকত। অমন আলুভাজা আর খাই নি। আমি অনেক বানাতে চেষ্টা করেছি। হয় নি। আমারটায় খুব বড় বড় ডিমের টুকরো হয়ে যায়। আয়েশা বুবুর মত শুধু ডিমের ছিটা ছিটা নয়। সিদ্ধ আটার রুটি ম্যাজিক রুটি। দুপুর পর্যন্ত শক্ত হত না।
আমাদের বাসার মহা কড়া স্বাস্থ্যরক্ষা আইনের জন্য আমার বা ছোটবোন শ্যামার কোনদিন স্কুলের সামনের আইসক্রিম বা তেঁতুলের আচার কিনে খাওয়া হয় নি। জুলজুল চোখে শুধু তাকিয়ে থেকেছি । জারুল গাছগুলোর নিচে লাইন করে ছেলে মেয়েরা আচার কিনতআইসক্রিম কিনত। কে বলেছে মেয়েরা নাকি শুধু তেঁতুলের আচার খায়আমাদের ক্লাশের মহা ভালো ছাত্র মেহেদী দেখিয়ে দেখিয়ে চেটে চেটে তেঁতুলের আচার খেত ।
মাঝে মাঝে টিফিনের সময় আমি আর শ্যামা হেঁটে বাড়ি আসতাম । খুব কাছে ছিল বাড়ি। বড় পুকুরটার পাশ দিয়ে স্কুলের বড় মাঠ টা পার করে একটা ছোট সাঁকো। তারপর বড় রাস্তা । পার হলেই সারি দিয়ে কাঁকনদের বাড়িদীনা মুনাদের বাড়িকাদের চাচীর বাড়িবুলাচাচীর বাড়ি। বাড়ি এসে মাঝে মাঝে দিদার রান্না করা মোচার ঘন্ট দিয়েও ভাত খেয়েছি । স্বর্গসুখ আর কাকে বলেপূর্বপাড়া থেকে যারা আসত তারা এমন বাড়ি যেতে পারত না।
স্কুলের মাঠের পাশে থাকত দুটো মুদিখানার দোকান। তপন বলল একটা দোকান ছিল ওয়াজিউল্লার। সেখানে ভাবি চাটনিটিকটিকির ডিম মানে ছোট ছোট গোল গোল লজেন্সকদমা পাওয়া যেত। থাকত গোলাপি কাগজে মোড়া নাবিস্কোর গ্লুকোজ বিস্কুটের প্যাকেট । মোসাওয়ার খবর দিল গোলাপি প্যাকেটের গায়ে আংগুরের ছবি আঁকা ছিল। হ্যাঁসাদা ট্রান্সপারেন্ট রঙ এ। আমাদের বাড়িতে লোক এলে চা-এর সাথে দেওয়ার মত খুব কিছু খাবার থাকত না। সুস্মিদের বাড়ি তো নয়! হোস্নেয়ারা মাসীর বানানো ডিমের হালুয়া কিংবা শাহী টুকরা নেই । কটকটে টোস্ট বিস্কুটের উপর মার বানানো পেয়ারার জেলি মাখিয়ে দেওয়া হত। তা আবার বাচ্চারা এলে চেটে বিস্কুট বাদ দিয়ে জেলিটাই খেয়ে ফেলত। থাকত কালো জিরা আর পিঁয়াজ ভেজে মুড়ি। আর একটু উচ্চ মানের গেস্ট এলে আমাদের হাতে তিনটা টাকা দিয়ে দৌড়ে স্কুলের মাঠের ওই মুদিখানার দোকানে গ্লুকোজ বিস্কুট আনতে বলা হত। খুব স্পেশাল ছিল এই গ্লুকোজ বিস্কুট। লোক চলে গেলে আমরা একটা দুটো পেতাম । আজও গ্লুকোজ বিস্কুটের স্বাদ আমার জিভে লেগে আছে।
আজকাল ওই সহজ জীবনের সরলতাটুকু জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। কাউন্টার টপের উপর তিরামিসু পড়ে থাকে। আমি ঘুরেও দেখি না।

(৩৫)
ঢোল কীর্তন ভাসান জারি
গাজীর গীত আর কালো সারি
বাংলাদেশের বয়াতিরা নাইচ্যা নাইচ্যা এমনে গায়।
আমার উসাহের শেষ নেই।  ভদ্র স্যারের কাছ থেকে জারিগান শিখে তাতেও নাম দিয়ে দিলাম।  পরনে লুঙ্গিকোমরে আর মাথায় লালসাদা ডুরেকাটা গামছা বাঁধা। জারিগানের জন্য তৈরী বয়াতি।  আসলে স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সবকিছুতেই নাম দিতাম অসীম সাহসী  আমি । বিতর্কউপস্থিত বক্তৃতাআবৃতিঅবাস্তব গল্প বলা... খালি রবীন্দ্রসংগীতনজরুল গীতিদেশাত্ববোধক গানে নাম দিতাম না লিসার ভয়ে। লাইসা আহমেদ লিসা! এদিকে গান আসলে আমি গাইতে পারতাম না।  তাতে কি?
মনে আছে একবার রোকেয়া হলের পিছনের পুকুরটার পাশ দিয়ে হাঁটছি।  বিরাট পুকুর। একপাশে শাপলা ফুটে আছে। সাদার  ভিতর হালকা হলুদের আভা। কিছু পাতাকুড়ানি ছেলে মেয়ে তা দিয়ে মালা বানিয়ে গলায় পড়ে চলেছে। ফুলটা লকেট।  কেউ কেউ মাছ ধরছে। পুকুরের কিনারায় শ্যাওলা জমে আছে।  পুকুরের জলে একটা অদ্ভুত ভেজা মাটির গন্ধ । সেই গন্ধ নাকে এসে  লাগছে। সাথে আমার খুব প্রিয় বন্ধুর ছোট ভাই। আমি গান শুরু করেছি খুব আবেগ দিয়ে, 'যে সুর গোপন গুহা হতে ছুটে আসে আকুল স্রোতেকান্নাসাগর-পানে যে যায় বুকের পাথর ঠেলে.....’ ভাইটি বলল, 'থাক না রমাদি।  সুর তো ঠিক লাগছে না। '  ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম।  আজকাল আমি কোন লোকজনের সামনে তারস্বরে তাই  গান গাই না।  যতই কুচকাওয়াজ ক'রা বীর বিক্রম হইনা কেন । যখন গাড়ি চালাই তখন শুধু একা একা গান করি।  আমার মেশিনগান।  খুব ভিড়ের রাস্তা দিয়ে যেতে নিয়ে মাঝে মাঝে নাকে অদ্ভুত  মিষ্টি পাউডারের গন্ধ এসে লাগে। মনে করতে পারি না কোথায় এ গন্ধ পেয়েছিলাম।  মানুষটাকে চিনি না। শুধু ভুলে যাওয়া স্মৃতিটুকু। তুলতুলে ভালোবাসার স্মৃতি। অচেনা মানুষের মত অচেনা ভালোবাসা পথ আগলে ধরে।  অনেক হাতড়েও বহু গানের কথা মনে করতে পারি না।
ইংরেজী কবিতা আবৃতিতে নাম দিতাম আমি।
‘Half a league, half a league,
 Half a league onward,
All in the valley of Death
 Rode the six hundred.’
কিংবা
‘O Captain! my Captain! our fearful trip is done,
The ship has weather’d every rack, the prize we sought is won,
The port is near, the bells I hear, the people all exulting,
While follow eyes the steady keel, the vessel grim and daring;
                         But O heart! heart! heart!
                         O the bleeding drops of red,
                         Where on the deck my Captain lies,
                         Fallen cold and dead.’
ইংরেজী উচ্চারণ ঠিক হবে না বলে যেতাম প্রাণের বন্ধু ইয়াসমিনের মা জোন মাসির কাছে। ইংল্যান্ডের লেক ডিস্ট্রিক্ট-এর মানুষ মাসি। হাসিব মেসোকে ভালোবেসে বাংলাদেশেই থাকেন ।
রাজশাহী ইউনিভার্সিটির ইংরেজী ডিপার্মেন্টে ইংরেজি পড়াতেন মাসি। আমাদের স্পোকেন ইংলিশ ক্লাশ নিতেন। খেলার ছলে বাড়িতেই ইংরেজী নাটকের অভিনয় করত ইয়াসমিনপ্যামেলা । মাসির কাছে শিখে।
ওদের সিন্ডি পুতুল ছিল। তাদের হাঁটুতে ভাজ করে বসানো যেত। আমার কি লোভ যে হত। মনে আছে আমি একবার করড্ররয় কাপড় দিয়ে পুতুলগুলোর স্কার্ট আর জ্যাকেট বানিয়েছিলাম। তাতে ট্যাক পিন দিয়ে বোতাম করেছিলাম।   
আমি এত সাজানোসুন্দরপরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন বাড়ি ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে আর দেখি নি। বসবার ঘরে ধবধবে সাদা একটু পুরু কাপড়ের টেবল ক্লথ। তাতে লেজি ডেজি ফুল তোলা হাল্কা নীলগোলাপিহলুদে। মাসী করেছেন। মাড় দিয়ে ইস্ত্রি করা । মাসির মত অসাধারণ কেক কেউ বানাতে পার না। ইয়াসমিন প্যামেলার অপূর্ব সুন্দর সব জামা মাসি মেশিন ছাড়া হাতেই সেলাই করতেন । সব সময় শাড়ী পড়তেন । মাথায় অপূর্ব এক পরিপাটি খোপা।
আমি ইয়াসমিনদের বাড়ির আগে ক্রীসমাস ট্রী দেখিনি কখনো । কিন্তু রাজশাহীতে ফারগাছ কইএকটা লিচুগাছের ডাল দিয়ে ক্রীসমাস ট্রী সাজানো হত ওদের বাড়ি। তাতে ঝুলত মাসীর একটা সোনালি রঙ্গের বলের মত অর্নামেন্ট। আগে কোনদিন অর্নামেন্টও দেখিনি। কি ভালোই যে লাগত আমার । বড় হয়ে যখন পাবলো নেরুদার মেমোয়ার পড়িবনের ভিতর সেই তিন ফ্রেঞ্চ বোনের কথা পড়তে গিয়ে জোন মাসির কথা মনে হত । নিজ দেশ থেকে বহুদূরে কিভাবে নিজের দেশের ঐতিহ্যটুকু ধরে রেখেছিল তিন বোন! কি আতিথেয়তা আর ফ্রেঞ্চ রান্না!
মানুষের ঔত্‌সুক্য কিন্তু কম ছিল না জোনমাসিকে নিয়ে। আমাদের স্কুলের কিছু আপাই তো। ইয়াসমিনকে ডেকে জিজ্ঞাসা, ‘তোমরা খ্রীষ্টান না মুসলমান?’ কোন মানুষকে এ ধরণের প্রশ্ন করাটা যে অশ্লীল তা কে কাকে শেখাবেতাও আবার স্কুলের শিক্ষিকাকে!
ইয়াসমিনরা হাসিব মেসো হঠাত করে মারা যাওয়ার কিছুদিন পর ইংল্যাণ্ড চলে গিয়েছিল ।  আজো মনে পড়ে সেইদিনটা ৮ই মে ছিল । আমার বুকের ভিতর তোলপাড়। এর আগে কোনদিন বন্ধু হারিয়ে ফেলি নি । ইয়াসমিন খুব বিভুতিভূষণ ভালোবাসত। আমায় যাবার আগে একটা ক্যাসেট ভরে অপুর কথা টেপ করে দিয়ে গেল ও। টানা টানা কাঁপা কাঁপা স্বর ইয়াসমিনের। আমি বারবার রিওয়াইন্ড করে করে তারপর রাত দিন শুনতে থাকলাম, ‘মাঝেরপাড়া স্টেশনের ডিস্‌ট্যান্ট সিগন্যালখানা দেখিতে দেখিতে কতদূরে অস্পষ্ট হইতে হইতে শেষে মিলাইয়া গেল...

(৩৬)

ক্লাশ ফাইভের বৃত্তি পরীক্ষার জন্য স্পেশাল ক্লাশ নিতেন গাফ্‌ফার স্যার । আর ক্লাশ এইটের বৃত্তি পরীক্ষার জন্য ক্লাশ নিতেন মাহবুব স্যারমোস্তফা স্যার। মোস্তফা স্যার করাতেন অঙ্ক আর মাহবুব স্যার ইংরেজী। আমি খালি ভাবতাম স্যাররা এত জানেনআমি কি কোনদিন তা শিখে উঠতে পারবমাহবুব স্যারের ইংরেজী গ্রামারের টেন্স-এর নিয়ম শুনে আমি শুধু ভাবতাম এমন কি কোনদিন হবে না যে আমি সব নিয়ম শিখে ফেলব আর মাহবুব স্যারকে এসে তাক লাগিয়ে দেবগরমের ছুটিতেও বৃত্তি পরীক্ষার জন্য কোচিং ক্লাশ করতাম আমরা। টিনের চালের নীচে গরম লাগত কিনা তা আর আজ মনে নেই। তবে মনে আছে মাঝে মাঝে ক্লাশের পরে টিসাদের বাড়ি যেতাম । ভিসি চাচার বাসার পাশেই মেহেদী আর টিসাদের বাড়ি। টিসার আব্বা ফারুক চাচা আমাদের দেখলেই ইংরেজী গ্রামার জিজ্ঞাসা করতেন । কী ভয় যে পেতাম । চাচা আজ নেই । চাচার মুখটা শুধু চোখে ভাসে । ভিসি চাচার বাড়ি আর টিসাদের বাড়ির মাঝের গলিটায়  সবুজ দূর্বা ঘাস। সেদিন রীপা বলছিল, ‘মনে আছে রমাআমরা কেমন স্যান্ডেল হাতে নিয়ে খালি পায়ে ঘাসের উপর হাঁটতাম?’ মনে আবার থাকবে নামানুষ অনেক বড় হয়ে যায় । কিন্তু ছেলেবেলার কোমলতা ভুলতে পারে না। কে কবে পাশে বসিয়ে আলতো করে পায়ে আলতা পড়িয়ে দিয়েছিল। কার সাথে যেন ঘাসের উপর শুয়ে আকাশের মেঘের ভিতর নরম তুলতুলে খরগোসের ছবি দেখেছিলাম। লালহলুদ আর সাদা দিয়ে স্পাইরালের মত করে রং করা ললিপপ খেতে খেতে রাস্তা ধরে বন্ধুদের সাথে হেঁটে গিয়েছিলাম। সেইসব দিনে মনে প্রাণে বিশ্বাস হত জীবনটা জটিল নয়জীবনটা শন পাপড়ির মত মুখে দিলেই জিহবার নীচে নরম হয়ে মিলিয়ে যাওয়ার । জীবনটা ভালোবাসবার।
টিসাদের বাড়িতেই আমি প্রথম ফাইবার অপটিকের ল্যাম্প দেখি । কি যে সুন্দর আলোর ফোয়ারার মত ঝরে পড়ছে । সাদানীলহালকা লাল। একটা মাথা ভেঙ্গে ফেললে ছোট হয়ে যাওয়া অংশ থেকেই আবার আলো ঝরছে । আলো ভোলা যায় না।
আর মেহেদীর কথা কি বলবআমি তো সব ক্লাশেই ফার্স্ট হই। কিন্তু ম্যাট্রিক পরীক্ষার টেস্টে মেহেদী চার নাম্বার বেশি পেয়ে ফার্স্ট ল । আমি তো স্কুলের এসেম্বলীতে সে রেজাল্ট শুনে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলাম। রিক্সা করে কোনমতে বাড়ি নিয়ে আসা হল। শাওন শুনে বলল, ‘The queen has lost her crown.’ আর আমার নিজের দাদুভাই কোনরকম সহানুভূতি না দেখিয়ে বলল, ‘কেনমেহেদী কেন ফার্স্ট হতে পারবে নাতুই ই খালি ভাত খাসও কি ঘাস খায়?’ নিজ বাড়ির লোকেরা এক দলে থাকবে সেটাই আশা করা উচিত নয় কিনাযুক্তির ছড়াছড়ি।
মনে পড়ে অনু স্যারমোস্তফা স্যারমানিক স্যারভদ্র স্যারগাফ্‌ফার স্যারমাহবুব স্যারমনিমুল হক স্যারপরেশ স্যারপেশকার স্যারআজিজ স্যার (পিটি স্যার)ফেরদৌসি আপাআসিয়া আপাহাফিজা আপাআম্বিয়া আপারুনু আপাফালাক বানু আপার কথা। আর স্কুলের পিয়ন গৌরদা।
যখন স্কুলে পড়তাম তখন মনে হয় স্যার আপারা তাঁদের তিরিশের কোঠায় ছিলেন। মনের ভিতর তাঁদের সেই বুদ্ধিদীপ্তঅল্প বয়সটাই গেঁথে আছে। তার পর প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর কেটে গেছে। জানি এখন ওঁনাদের দেখলে আমার বুকের ভিতরটা ধক করে উঠবে। কোন কথাই হয়ত বলতে পারব না। সবাইকে তো দেখতেও পাব না। সেদিন চুমকি বলল জানিস আমাদের অনেক স্যারআপারাই আর নেই- ফালাক আপাআম্বিয়া আপারুনু আপাহাফিজা আপাগফফার স্যার...
আমার পৃথিবীতে ভয় আর ভালোবাসা মনের ভিতর একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়ে যে সব মানুষদের জন্য তাঁরা স্কুলের স্যার আর আপা । তাঁরা সারা জীবন জীবনের অংশ হয়ে হৃতপিন্ডের ভিতর বসবাস করেন ।
স্কুলের দিন একসময় শেষ হল । সমাপনীর দিন আবৃত্তি করলাম কাজী নজরুল ইসলামের সংকল্প ।
থাকব না কো বদ্ধ ঘরেদেখব এবার জগটাকে, –
কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে।
দেশ হতে দেশ দেশান্তরে
ছুটছে তারা কেমন করে,
কিসের নেশায় কেমন করে মরছে যে বীর লাখে লাখে,
কিসের আশায় করছে তারা বরণ মরন-যন্ত্রণারে।।
কেমন করে বীর ডুবুরি সিন্ধু সেঁচে মুক্তা আনে,
কেমন করে দুঃসাহসী চলছে উড়ে স্বর্গপানে।
জাপটে ধরে ঢেউয়ের ঝুঁটি
যুদ্ধ-জাহাজ চলছে ছুটি,
কেমন করে আনছে মানিক বোঝাই করে সিন্ধু-যানে,
কেমন জোরে টানলে সাগর উথলে ওঠে জোয়ার-বানে।
কেমন করে মথলে পাথার লক্ষ্মী ওঠেন পাতাল ফুঁড়ে,
কিসের আভিযানে মানুষ চলছে হিমালয়ের চুড়ে।
তুহিন মেরু পার হয়ে যায়
সন্ধানীরা কিসের আশায়;
হাউই চড়ে চায় যেতে কে চন্দ্রলোকের অচিন পুরে;
শুনবো আমিইঙ্গিত কোন মঙ্গল’ হতে আসছে উড়ে।।...
রইব না কো বদ্ধ খাঁচায়দেখব এ-সব ভুবন ঘুরে-
আকাশ-বাতাস চন্দ্র-তারায় সাগর-জলে পাহাড়-চুড়ে।
আমার সীমার বাঁধন টুটে
দশ দিকেতে পড়ব লুটে;
পাতাল ফেড়ে নামব নীচেওঠব আবার আকাশ ফুঁড়ে;
বিশ্ব- জগ দেখবো আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে।।
সংকল্প তো করলাম। কিন্তু দম এদিকে বন্ধ হয়ে আসছে। সেই ক্লাশ টু তে ভর্তি হয়েছিলাম রাজশাহী ইউনিভার্সিটি এক্সপেরিমেন্টাল স্কুলে । এতদিনের স্কুলএতদিনের ভালোবাসাএতদিনের এত কথা সব ফেলে যেতে হবেনীল সাদা স্কুলড্রেস পড়ে আর এখানে আসা হবে না। আমার পথের বাঁকে এখন অন্য পথ এসে মিশেছে। সেই নতুন পথ দিয়ে আমি হেঁটে যাব । কুমির তোর জলে নেমেছি...’ ‘এল ও এন ডি ও এনলন্ডন...’ ‘টি টি টি তোমার কিরণ চাই...’ ধীরে ধীরে সব পিছনে মিলিয়ে যাবে।
স্কুলের সমাপনী সভায় আমাকে বক্তৃতা দিতে বলা হ’ল। খুব কিছু বলতে পারলাম না। গলার কাছে এতগুলো বছরের সব দিন একসাথে ভিড় ক’রে একটা দলা পাকিয়ে উঠল। কোনমতে শুধু বললাম, ‘রাতের সব তারাই থাকে দিনের আলোর গভীরে।’




Comments



কল্যাণী রমা-র জন্ম ঢাকায়। ছেলেবেলা কেটেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। ভারতের খড়গপুর আই আই টি থেকে ইলেকট্রনিক্স এ্যান্ড ইলেকট্রিক্যাল কমুনিকেশন ইঞ্জিনীয়ারিং-এ বি টেক করেছেন । এখন আমেরিকার উইস্কনসিনে থাকেন। অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট সিনিয়র ইঞ্জিনীয়ার হিসাবে কাজ করছেন ম্যাডিসনে।
প্রকাশিত বইঃ
আমার ঘরোয়া গল্প;
হাতের পাতায় গল্পগুলো – ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা;
রাত বৃষ্টি বুনোহাঁস – অ্যান সেক্সটন, সিলভিয়া প্লাথ, মেরি অলিভারের কবিতা;
মরণ হ’তে জাগি – হেনরিক ইবসেনের নাটক;
রেশমগুটি;
জলরঙ;
দমবন্ধ।


Popular Posts